ঈশ্বর অথবা যৌনতা সম্বন্ধে যে দু-তিনটে কথা আমার বলার
প্রীতম সরকার
প্রথমত আমি কোনো পেশাদার সমালোচক নই , তাই সুপ্রিয় সাহার
“ঈশ্বর অথবা যৌনতার গল্প” নিয়ে আমি যা লিখব তা একান্ত ভাবেই একজন সাধারন পাঠকের
মতামত। শুরুতেই বলে রাখি, সুপ্রিয় সাহা এ যুগের গল্পকার, তাঁর লেখার স্টাইলে যে freshness আছে তা শুধু সময়ের
সাথে চলা একজন লেখকের লেখার মধ্যেই থাকতে পারে বলে আমার বিশ্বাস, তাই তিনি
ভীষণভাবে এযুগেরই। “ঈশ্বর অথবা যৌনতার গল্প” বইটিতে মোট গল্প রয়েছে ৮ টি। একথা বোঝাই যায় যে তিনি অনেকটা সময় আর ধৈর্য্য নিয়ে গল্প গুলি সিলেক্ট করেছেন ।
এবার আসা যাক গল্পে। মানে যে যে গল্পগুলো পড়ে আমার তাদের
নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে সেই গল্প গুলোর কাছে, কারন সব গুলো লেখা নিয়ে আলোচনার সময় ও স্পেস কোনটাই নেই এখন । প্রথমেই যাওয়া যাক সেই গল্পটার
কাছে যেটার নামে সুপ্রিয় সাহা তার নিজের বইয়ের নাম দিয়েছেন। “যৌনতা অথবা ঈশ্বরের
গল্প”। ঝামেলা না বাড়িয়ে প্রথমেই দুটো কথা বলে নেওয়া ভালো। প্রথম কথা, এই গল্পটার
একটা অসুবিধে আছে। গল্পটা বারবার করে পড়লেও কেউ এই গল্পের চরিত্রদের সামাজিক
অবস্থানটা ঠিক বুঝতে পারবেনা। মানে চরিত্রগুলো সমাজের ঠিক কোন জায়গাটায় রয়েছে?
এখানে বিজ্ঞের মতো বললে হবেনা যে, এরা সমাজের সর্বত্রই রয়েছে কারন এদের যা চারিত্রিক
বৈশিষ্ঠ তাতে এদেরকে সবার সাথে এক করা যায়না। এরা আমার বাড়ির পাশের পলটুদা বা
আপনার পাশের ফ্ল্যাটের শ্যামলী বৌদি হতে পারবে না, তাই এদের অবস্থানের একটা আন্দাজ
দেওয়া at least উচিত ছিল। লালের
পেচ্ছাপের সাথে রক্ত বেরোয়, সে তো ‘বিজনের রক্তমাংসে’ বিজনেরও বেরিয়েছিল, কিন্তু
সেখানে বিজন স্পষ্ট ছিল। বিজন বাসে-ট্রামে চড়তো, ছাপোষা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে
বেরিয়ে আসা একটা চরিত্র, পাঠকরা বিজনের ছবিটা দেখতে পেয়েছিল। এখানে গল্পের একটা
চরিত্র লাল খালাসিটোলার ভক্ত নাকি New Cathe তে গিয়ে 100 pipers অর্ডার দেয় সেটাই বোঝা গেল না। লালের
ছবিটা আঁকতে পারলাম না। গল্পের নায়িকার (বা বিদিশার) ব্যাকগ্রাউন্ড তো আরও
অস্পষ্ট। হটাত করে “যদি কোন সুতোয় একটু রক্তের ছোঁয়া পেয়ে যাই দশ বারো বছরের এক
বাচ্চা কমিউনিস্ট মেয়ের”- এই লাইনটা use করে
সুপ্রিয় বাবু কি বোঝাতে চাইলেন তা আমার মতো ভোঁতা পাঠকের বোধের অগম্য।
দ্বিতীয় কথা, সুপ্রিয় বাবু নিজে রোজ রাতে স্বপ্ন দেখেন কিনা
জানিনা তবে ওনার চরিত্ররা ভরপুর স্বপ্ন দেখে। তার প্রায় সমস্ত গল্পেই স্বপ্নের
একটা বড় ভূমিকা আছে। কোনো কোনো জায়গায় স্বপ্ন এসে narration কে ইচ্ছে করেই ভেঙে দিয়েছে
কোথাও আবার স্বপ্নের মধ্যে দিয়েই narration এগিয়েছে। এই গল্পেই স্বপ্নকে সুপ্রিয় বাবু সফল
ভাবে ব্যবহার করেছেন। টানা narration এর ভারী গল্প এটা নয়। মাঝে
মাঝেই দৃশ্যপট পাল্টে পাল্টে গেছে, চরিত্ররা আমাদের না জানিয়েই নিজেদের জমি জায়গা
বদল করেছেন। আর পুর ব্যাপারটাই কেমন যেন একটা স্বপ্ন। আবার স্বপ্নের ভিতরেও স্বপ্ন
আছে এবং সেই স্বপ্নের জল পুলিশ যখন বলে, ‘এভাবে বালি বালি খেলা এখানে মানা আছে’
তখন সত্যিই পড়া থামিয়ে দুমিনিট শুধু লাইনটা নিয়েই ভাবতে হয়। গল্পটা সত্যিই অনবদ্য
একটা effort । স্বপ্নের মতো ভেসে বেড়ানো
গল্পের লাইনগুলো আপনার কব্জি ধরে টান মেরে গল্পের ভিতর ঢুকিয়ে নিয়ে যাবে। তবে
স্বপ্নটা একবার ভাঙলেও ভালো লাগত, একবার ঘুমের ঘোরটা গল্পটা থেকে কাটলে বোধ হয়
একটু বেশি ভালো লাগত। আসলে কি জানেন সুপ্রিয় বাবু, স্বপ্নের চরিত্রদের নিজস্ব কোন say থাকেনা, তারা আসলে সব বোবা।
আর যেটা বলার সেটা হলো, ইউসুফের কথা। ইউসুফ হল এই গল্পের
একটা ফুটো। যে ফুটো দিয়ে ঈশ্বর অতর্কিতে এই গল্পে প্রবেশ করেছে। সত্যিই বলছি
আল্লার উপাসক এই মুসলিম ছেলেটি না থাকলে ঈশ্বর এই গল্পে ঠাঁই পেতেন না। স্বপ্নের
মানে বলে দেওয়া ইউসুফকে আমাদেরও দরকার। আমরা পাইনি ইউসুফকে, তবে সুপ্রিয় বাবু
পেয়েছেন। তাকে না পেলে যে গল্পের বাকী দুই পুরুষ চরিত্রের কি দশা হত কে জানে!
একজন লেখক তার গল্প বলার মধ্যে দিয়ে ঘুরেফিরে বেড়ান । তার
চরিত্রগুলোর সাথেই তিনি নিজেও হেঁটে চলে বেড়ান এদিক সেদিক । সুপ্রিয়বাবুর
চরিত্রগুলোও এখানে ওখানে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছিল । তবে তাদের নিজেদের মধ্যেকার দূরত্ব
খুব বেশী ছিল না । কাছাকাছিই থাকতো তারা । তবে হঠাৎ করে ছিত্যামনি ছিটকে গিয়ে বেশ
অনেকটাই দূরে পড়লো ।সুপ্রিয়বাবুর বাকী চরিত্রগুলোর থেকে অনেক অনেক দূরে ছিত্যামনি
জঙ্গলমহলের একটি চরিত্র । আরবান স্টোরি টেলরদের কাছে জঙ্গলমহল একটি অনেক দূরের
বিষয়। সুপ্রিয় যে তার একটা চরিত্রকে ওখানে নিয়ে গিয়ে ফেলতে পেরেছে তার জন্য পিঠ
চাপড়ানি দেওয়া যেতেই পারে ।
গল্পের নাম ‘কাঁড়বাঁশ’ এই গল্পেরই চরিত্র ছিত্যামনি এবং সে
থাকে জঙ্গলমহলে। টানা ন্যারেশানে লেখা বলেই হয়তো এই গল্পের চরিত্রগুলো বেশ স্পষ্ট
। ছিত্যামনির বিয়ে হয়েছিল বাঁশপাহাড়ির পচাপানিতে। গল্পের এই বাঁশপাহাড়ির সঙ্গে
কিছুদিন আগে খবরের শিরোনামে থাকা বেলপাহাড়ি মাওবাদী মুক্তাঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্যতম
ছিল এবং সুপ্রিয়বাবুর ‘কাঁড়বাঁশ’ গল্পটাও একটা মুক্তাঞ্চলেরই গল্প। পরিপ্রেক্ষিতে
এত মালমশলা যখন রয়েছে তখন স্বভাবতই একটা প্রশ্ন আসবেই যে তাহলে এটা কি একটা
রাজনৈতিক গল্প ? গল্পের শেষের প্যারাগ্রাফটা না পড়লে এটাকে কিছুটা ওই গরীব দুঃখী
মানুষদের জীবনের ট্রাজেডির গল্প বলে চালিয়ে দেওয়া যেত, কিন্তু শেষে প্যারাগ্রাফটা
বিশেষ করে শেষের চার-পাঁচটা লাইন পড়ার পর এটা বলতেই হচ্ছে যে লেখক একটা রাজনৈতিক
গল্পই লিখতে চেয়েছেন । গল্পের শেষে একজোট হওয়ার একটা ইঙ্গিত দেওয়া রয়েছে এই
লাইনগুলোর মধ্যে – “একহাত মুঠো করে চিৎকার করে ওঠে ও। তারপর ছুটতে থাকে।ছুটতে থাকে
এই জল-জঙ্গল-সময়কে ভেদ করে । পিছনে ছোটে নবনীতা, ঠাকুরমনি, লবু আর সবিতারা।” একটা
ভিন্ন জনমত গড়ে ওঠার আভাস পাওয়া যায় । চরিত্রগুলো যেন ফেটে পড়তে চায়। তবে
সুপ্রিয়বাবু তার সিগনেচার এখানেও রেখেছেন, ওপরে লেখা সবই তিনি স্বপ্নের মধ্যেই
ঘটিয়েছেন । তবে যেভাবেই হোক তিনি যেটা লিখতে চেয়েছিলেন সেটা তিনি সহজেই উতরে
দিয়েছেন । সমস্যাটা সেটা নয়,সমস্যাটা অন্য জায়গায় ।
আর কথা না বাড়িয়ে এবার সমস্যার জায়গাতেই আসা যাক । সমস্যাটা
হল তিনি গল্পের প্রথমে যে কথাগুলো ব্ললেন পরে সেগুলোকেই কন্ট্রাডিক্ট করে গেলেন
কেন? এরকম করলে আমাদের মতো অতি সাধারণ পাঠকদের খুবই অসুবিধের মধ্যে পড়তে হয় ।
ব্যাপারটা এইরকম- গল্পের প্রথমদিকে লেখক বললেন- “জঙ্গলের ভিতরের লোকের বিরুদ্ধেও
কিছু করার নেই আর বাইরের লোকেদের বিরুদ্ধেও কিছু করার নেই। ” কথাটা পড়ার পর আমার
মতো পাঠকেরা ধরে নিল যে, এটা সেই স্যান্ডুইচ হয়ে যাওয়া মানুষদের গল্প । একটা গোটা
কমিউনিটি কি ভাবে দু’দিকের প্রচণ্ড চাপে আস্তে আস্তে চিড়েচ্যাপটা হয়ে যাচ্ছে তারই
গল্প । লেখক বুঝি স্টেট বা আন্টি-স্টেট রেবেল এই দুইয়ের কারোর দিকেই ঝুঁকবেন না,
শুধু মাঝে পড়ে থাকা মানুষদের দুঃখ-দুর্দশা-হতাশা-বাসনা এসবের গল্পই বলবেন । গল্প
চলছিলও সেই দিকেই । প্রান্তিক মানুষেরা তাদের নিজেদের অবস্থার কথা নিজেরাই বলে
যাচ্ছিল । তবে গল্প যত এগোয় তার রাজনৈতিক বক্তব্যটা যেন পাল্টে যেতে থাকে । এরপর
থেকে সুপ্রিয়বাবু রাস্ট্রের যৌথবাহিনীকেই খানিকটা যেন দোষারোপ করে গেছেন । ক্ষমতার
অলিন্দে থাকা কেউই ক্ষমতার চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেনা, তাই রাস্ট্রের দমন-পীড়নও
নতুন কথা নয়। লেখক চাইলেই রাস্ট্রের বিরুদ্ধে মতামত রাখতেই পারেন । লেখক এই
গল্পতেও শেষের দিকে রাস্ট্রের ভুলই বেশী ধরেছেন। রাষ্ট্রবিরোধীদের জেতাননি ঠিকই
কারণ তা সম্ভব ছিল না, কিন্তু সেরকম কড়া কথাও বলেননি । আন্টি-স্টেট মুভমেন্ট এ
কোনও ফল পাওয়া যাচ্ছে না তিনি এ ব্যাপারে হতাশও । যেমন তিনি তার হতাশাকে রূপ
দিয়েছেন ‘সবিতাদি’ নামের একটি চরিত্রর মধ্য দিয়ে । কিন্তু এটা তো আর স্যান্ডুইচ
থিয়োরি রইল না । কারণ ভুল তিনি আন্টি-স্টেট মুভমেন্টে দেখছেন না বরং তিনি তাদের
অসফলতায় হতাশ। তাহলে এই গল্পের পলিটিকাল স্টেটমেন্টটা আসলে কি? মাওবাদীদের
আন্দোলনের ফলে গ্রামবাসীদের ওপর পুলিশি অত্যাচার বেড়েছে, এটাই একমাত্র দোষ
মাওবাদীদের ? তাহলে কি ছিত্যামনি গল্পের শেষে কাঁড়বাঁশ উঁচিয়ে তেড়ে গেল পুলিশের
দিকেই? কারণ অত্যাচারের নিরিখে তারাই তো এগিয়ে । না এই তেড়ে যাওয়া দু’দলের
দিকেই?স্যান্ডুইচ হয়ে যাওয়া মানুষের ফেটে পড়ার গল্পই ‘কাঁড়বাঁশ’ ? সুপ্রিয়বাবু
বোধহয় ইচ্ছে করেই ব্যাপারটাকে পরিষ্কার করলেন না ।
একদম শেষে খুব ছোট্ট করে যে গলপটার কথা বলতে চাই সেটার নাম
লেখক দিয়েছেন ‘অতনুর নামগন্ধ’। এই গল্পটা ব্যক্তিগত ভাবে আমার খারাপ লাগেনি । এটা
খুব সোজা গল্প । সুপ্রিয়বাবু সোজাসাপটা গল্প খুব একটা বলতে চান না তবে এটাতে
বলেছেন । এটা একটা সাধারণ প্রেম-সন্দেহ-রাগ এবং প্রতিশোধের হয়েই থাকতে পারতো,
গল্পটাকে অন্য কোথাও না নিয়ে গেলেও চলতো তবে এতটা ঠিক লেখক মেনে নিতে পারলেন না ।
একে সোজা গল্প তারপরে যদি সেটাকে আর পাঁচটা নিছক প্রেম বা প্রতিশোধের গল্পের মতো
করেই বলে ফেলি তাহলে আর আমি থাকি কোথায়! এই ভয়টা বোধহয় লেখকের ছিল এবং এই ভয়
থাকাটা অন্যায়েরও নয় । তবে লিনিয়ার গল্প বলার মধ্যে নতুনত্ব আনতে হলে গল্প বলার
ভাষাটায় নতুনত্ব আনলেই ভালো, তাতে পুরনো গল্পটাকে নতুন বলে মনে হতে পারে । সেটা না
করে সুপ্রিয়বাবু দুম করে গল্পের স্ট্রাকচার নিয়ে পড়লেন । তিনি গল্পটাকে শুরু করলেন
একটা আচমকা সিনের মধ্যে দিয়ে । কি কারণে তিনি ওই সিনটা ইউজ করলেন তা বলতে পারি না
তবে সেটার সাথে মূল গল্পটার সেরকম সম্পর্ক নেই।এর ফলে যেটা হল সেটা ভারী অদ্ভুত
একটা ব্যাপার । গল্পের প্রথম পরিচ্ছেদটা কেমন যেন গল্পের থেকে আলাদা হয়ে পড়ে রইলো
। গল্পটা পড়ার পর মনে হল যেন গল্পটা আসলে দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ থেকে শুরু হল, প্রথম
দুটো পাতা যেন এমনি এমনিই লেখা হয়েছে । একটা টানা লিনিয়ার গল্পের গোড়ায় ওরকম একটা
পরম্পরাহীন পরিচ্ছেদের দরকারটা অন্তত আমি ঠিক বুঝলাম না । তবে বাকী গল্পটা বেশ
ভালই (আগেই বলেছি)। বেসিক্যালি প্রেম ও তার থেকে তৈরি হওয়া কিছু দৈত্যরই গল্প
বোধহয় । তবে গল্পের শুরুতেই সুপ্রিয়বাবু লিখেছেন (হয়তো পাঠকদের উদ্দেশ্যে)
“অ্যাক্টিভিস্ট কাকে বলা যায়। আমাকে না অতনুকে? নাকি সবটাই ভাঁওতা? ” আমার মতামত
যদি সুপ্রিয়বাবু জানতে চান তাহলে বলতে পারি এই গল্পে অ্যাক্টিভিস্ট কেউই নয়,
অ্যাক্টিভিসম এ গল্পে নেই এবং এক্ষেত্রে বোধহয় “সবটাই ভাঁওতা”।
এই তরতাজা সংকলনের বাকি গল্পগুলি রইল বিভিন্ন পাঠকের বিভিন্ন মতামতের অপেক্ষায়...
বড়ই কঠিন বই ! 'ঈশ্বর ও যৌনতার গল্প' গল্পটা পড়ে আমার মনে হয়েছিল বিদিশা আর ১২বছরের মেয়েটি আসলে আলাদা দুটো চরিত্র।
ReplyDeleteযতদূর আমি জানি, তারা তো দুজন তো দুটো আলাদা চরিত্রই
ReplyDeletePritam sarkar ekjon valo pathok holeo samalochok non.choto galpor bivinno ghorana ache,sera bojha joruri
ReplyDelete