কবিতার অনন্ত ঋতু
সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়
“ গতকালের কথা আজ কত
দূরের যেন ,
সঞ্চয় বলতে কিছু শব্দ, মুহূর্তের সুরে
বৃষ্টি ভেজার মতো ক্রমশ সিক্ত হয়ে, নরম হয়ে
বেঁচে থাকা তোর উদাসীনতায়
তুই ফোন ধরিসনি , আমাকে রিজেকট লিস্টে
পাঠিয়ে...”
(সুগন্ধ স্মৃতি)
সত্যিই আমাদের গতকালের
কথাগুলো, না-ধরা ফোনকল, আরও কট ছোটখাট কথা আর কান্নার রেশ এভাবেই একদিন ঝাপসা হতে
হতে মিলিয়ে যায়...মিলিয়ে কি যায় , নাকি কোথাও জেগে থাকে দিকনির্দেশহীন জোনাকির
মতো? হয়ত সারা জীবন, এই আয়ুষ্কাল জুড়ে পড়ে থাকে কোথাও, পেরিয়ে যায় ঋতুর বদল...তবু
যেন ছায়াপথে রয়ে যায় হারানো সম্পর্কের চিঠি , আমরা সেই চিঠি মাঝে মাঝে খুলে পড়ি,
আবার বন্ধ করে দি , অথবা তা নিয়ে লিখে ফেলি দু-চার কলম। যেমন লিখেছেন কবি বৈদূর্য্য সরকার, তার ২০১৫ সালে প্রকাশিত ‘ঋতুকাহন’ বইটিতে । বইয়ের
সমস্ত কবিতা সেই হারিয়ে ফেলা প্রেমিকার জন্যে লেখা যাকে আর কোনদিন ছোঁয়া যাবেনা,
যাকে বলা যাবেনা- ‘আমার বিচ্ছিরি নিরুত্তাপ বেঁচে থাকায় / ভীষণ আনপ্রেডিকটেবল তুই
ঢুকে পড়িস...’ , যার সুগন্ধি স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়াবে সর্বক্ষণ তবু যাকে নিয়ে শহর
থেকে শহরতলি, শালবন থেকে উত্তরবঙ্গের চা-বাগান আর যাওয়া হয়ে উঠবেনা কোনও বর্ষার
মেঘময় দিনে কিংবা গেরুয়া রঙের চৈত্রের গোধূলিতে। এই হারানোর নীল রুমাল উড়ে আসে বৈদূর্য্য -এর কবিতায়, এবং বাংলা প্রেমের কবিতার প্রচলিত ধারা না মেনেও নিজস্ব ভঙ্গিমায়
নিজের কবিতা লিখতে তিনি সফল।
“ হাতচারেক দূর থেকে ওয়েস্ট বক্সে ছুঁড়ে দিচ্ছিস আমাকে,
চিররহস্যে ঢাকা দ্বীপে নড়বড়ে সাঁকো
পেরোতে পারিনি বলে
অন্যপারে চলে গেছিস তুই হাত ছেড়ে, বালিকার কৌতূহলে...”
(বাতিল গল্প)
ওপরে উদ্ধৃত কবিতাটির আর্তি হৃদয় ছুঁয়ে যায়, নাড়িয়ে যায় মন...আমরা যারা
ভালোবেসেও সাঁকো পেরোতে পারিনি, ফলে চলে গেছি অনিবার্য ওয়েস্ট পেপার বাক্সে, যারা
এখনো দেখতে পাই অন্যপারে মিলিয়ে যাচ্ছে ছায়া, তাদের সবার কথা বলে যায় এই কবিতা।
দুটো নদী মিলতে পারে, কিন্তু দুটো মানুষ পারেনা, একা পড়ে থাকে চিররহস্যে ঢাকা
দ্বীপে – মেরুন দুঃখের এই জীবন নিয়েই আমাদের পথ হাঁটা, চলাচল। ‘বালিকার কৌতূহল’ –
এই ব্যবহার ভাবায়, প্রেমিকের মেয়েটির প্রতি তীব্র ভালবাসাময় অভিমান গাঁথা এই দুটি
শব্দে। এ ভাবেই, শব্দ থেকে শব্দে, অক্ষর থেকে অক্ষরে , পঙক্তি থেকে পঙক্তি ,
হেমন্ত থেকে শীত, বৈশাখ থেকে চৈত্র, বসন্তের রাধাচূড়া-পথ থেকে শহুরে শরতের
আগমনীবার্তা – হাল্কা মেঘের মত ভেসে বেড়ায় ‘ঋতুকাহন’ ।
বৈদূর্য্য -এর কবিতার ভাষা তার নিজস্ব, এবং তা
আশা জাগায় কারন ‘ভালো’ কবিতা বাংলায় অনেক লেখা হয়ে গেছে, আরো হবে, কিন্তু সিগনেচার
খুব জরুরি। খুব ছন্দ মেনে তিনি লেখেননি , তবে কবিতার অর্ন্তলীন যে ছন্দ তা তাঁর
কবিতায় খোলা হাওয়ার মত বয়ে গেছে। ব্রায়ান অ্যাডামস লিখেছিলেন –“Let’s make a night to
remember...January to December...”; বৈদূর্য্য সরকারও তাঁর ‘ঋতুকাহন’
গ্রন্থে এঁকেছেন এক ঋতু পেরিয়ে হেঁটে চলা প্রেমের অনন্ত ছবি যা কোনো সময়রেখা মানেনি।
তবে, আগামী দিনে, প্রেমের নস্টালজিয়ার বাইরে বেরিয়ে কবিতার অনন্ত ভুবন ছোঁয়ার
চেষ্টা তিনি করবেন, এই আশা রাখি।
No comments:
Post a Comment