Tuesday, July 5, 2016

পাখিদের দ্বীপ / সায়ন্তনী নাগ


নিটোল নিখাদ কাহিনী নির্ভর গল্প


বসুন্ধরা মণ্ডল






সায়ন্তনী নাগের ‘পাখিদের দ্বীপ’ বইটি প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে।মোট ২১টি গল্প নিয়ে এই সংকলন। বইটিতে ২০০৫ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে বিভিন্ন পত্রিকায়এবং ওয়েব-ম্যাগাজিনে প্রকাশিত গল্প ঠাই পেয়েছে।


 এই সংকলনের গল্পগুলি মূলত নিটোল নিখাদ কাহিনী নির্ভর গল্প। এই সব কাহিনী নির্ভর গল্পগুলির মধ্যে একটু আলাদা স্বাদের ব্যাঞ্জনাধর্মী গল্প হল ‘পাখিদের দ্বীপ’ আর ‘ওরা দুজন’। ‘পাখিদের দ্বীপ’ গল্পটি ইঙ্গিতময় হওয়ায় পাঠক নিজের মতো করে হিসেব মিলিয়ে নিতে পারেন। মানসিক অবসাদে ভুগতে থাকা কথক চরিত্ররই নাম আসলে সুনীপা। নিজের নাম, অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে সে ভাবছে সুনীপা আসলে তার বন্ধু।অথবা সুনীপা তার অলটার ইগো। এমনও হতে পারে মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারে ভুগতে থাকা মেয়েটি নিজেই পেশায় ছিল মনরোগবিশেষজ্ঞ। বিবাহিত; যৌন-ক্ষুধার্ত পুরুষের সঙ্গে লিভটুগেদার করার দেড়-দুবছর পর তার বউ বাচ্চা সমেত এসে সামনে দাঁড়ায়। শুধু সেই প্রেম ভেঙে যাওয়ার কষ্ট নয়, পাশাপাশি নিজের সন্তানকে জন্মের আগেই মেরে ফেলার যন্ত্রণা তার এই অবস্থার জন্যে দায়ি। পরিযায়ী পাখি যেমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজের দেশ ছেড়ে চলে আসে গরমের দেশে, আবার শীত মিটলে চলে যায় নিজের দেশে, তেমনি রাজু বউয়ের প্রেগ্নেন্সির কারণে শরীরের খিদে মেটাতে আসে তার কাছে, আবার ফিরেও যায় ঠিক সময়ে। তবে কিছু পাখির শাবক যারা এখানকার দ্বীপে জন্মায়, তারা কেউ কেউ থেকেও যায়। কিন্তু তার বাচ্চাটাসেই পরিযায়ী পাখিদের মতো থাকেনি ।তাই সে সেই পাখিদের ছোঁয়া পাওয়ার জন্যে যেতে চায় পাখিদের দ্বীপে।

‘ওরা দুজন’ গল্পটি ব্যাঞ্জনাধর্মী গল্প। রোল-চাউমিনের দোকানদার এই গল্পের কথক। সে নিজের দোকানে আসা দুই তরুণ তরুণীকে ধর্নায়, প্রতিবাদ সভায়, মিছিলে, মোমবাতি মিছিলে দেখতে পায়। কিন্তু তারা অস্বীকার করে সে কথা। ‘জয় জওয়ান স্টলে’র মালিক বুঝে উঠতে পারেনা কেন তারা অস্বীকার করে বারবার। যখন সাধারণ মানুষের জন্যে প্রতিবাদ করা মৃত মানুষদের ছবিতে তাদেরকে দেখতে পায়, তখন সে প্রাণপণে অস্বীকার করতে থাকে:  যে মৃতের দলে তারা রয়েছে। আসলে দুর্নীতি, অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়তে থাকা মানুষ তারা, তাদের মৃত্যু হতে পারেনা। তারা বেঁচে থেকে যায় কথকের মতো গড়পড়তা মানুষের মধ্যে। সেই জন্যেই কথক  নিজে আয়নার সামনে দাঁড়ালে তার নিজেকে ওদের মতো দেখতে লাগে।

সায়ন্তনী নাগের চমকপ্রদ পরিণতির প্রতি বেশ ঝোঁক আছে দেখা যায়। এবং এই চমকপ্রদ পরিণতির কৌশল প্রয়োগ কারার ক্ষেত্রে তাঁর সাফল্য অনেকখানি। যদিও ‘শরণাগত’, ‘নির্দোষ’, গল্প দুটির পরিণতি আগে থেকেই পাঠক আন্দাজ করে নিতে পারেন। কিন্তু ‘ক্যামেরাম্যান’, ‘বকলমে’ গল্পদুটি সত্যিই চমকে দেয়। এক স্বার্থপর ক্যামেরাম্যানের  ডিভোর্সি এক মেয়েকে ব্যাবহার করার গল্প শোনা যায় মেয়েটির বয়ানে। কিন্তু গল্পের পরিণতিতে আসা একটা চিঠি সেই মানুষটা সম্পর্কে কথকের এবং পাঠকের ধারণাকে একটাই আঘাতে একসঙ্গে ভেঙে ফেলে। আত্মকথন রীতির এতো সার্থক ব্যাবহার মুগ্ধ করে। ‘বকলমে’ গল্পের ক্ষেত্রেও দেখা যায় কলেজ জীবন থেকে যার একটি লেখা পড়ে মনের মধ্যে বহু যত্নে তার ভাবচিত্র বানিয়ে ভালবাসা লালন করে গেছেন মানস বাবু, সেই মেয়েটি আসলে মোটেই তেমনটি নয়। যে লেখা পড়ে তিনি মেয়েটির প্রেমে পরেছিলেন তা আসলে লিখেছিল পাশের বাড়ির দেবেন কাকু।

বইটির আটটি অনুগল্প বেশ ভালো লাগে। ‘সন্ধ্যার গল্প’তে খুব অল্প পরিসরে লেখিকা তুলে ধরেন একটা হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ের সংগ্রাম করে বেড়ে ওঠার প্রয়াসকে। তার মায়ের পাঁকে ডুবে থাকা জীবনের আওতা থেকে বেরতে চাওয়ার কাহিনী। উল্টোদিকে ‘আত্মজা’ গল্পে একটি মেয়ের স্বেচ্ছাচারী জীবন যাপন, আর তার মায়ের উদ্বিগ্ন জীবন কাটানোর কাহিনী। অন্য অনুগল্পগুলিও পড়তে বেশ ভালো লাগে।
 
লেখিকার কিছু অসাবধানতাও চোখে পড়ে। বিশেষত ‘টুম্পার বসে আঁকো’ গল্পটির ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে বেশ অনেক ত্রুটি চোখে পড়ে। বিশেষত ক্রিয়াপদগুলি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আঞ্চলিকতা মুক্ত, কিংবা সঠিক বৈশিষ্ট যুক্ত নয়। শুধুমাত্র সঘোষ ধ্বনিকে অঘোষ, এবং মাহাপ্রান ধ্বনিকে অল্পপ্রান ধ্বনি বানিয়ে দিলেই তা যথাযথ আঞ্চলিক ভাষা হয়ে উঠতে নাও পারে, এটা লেখিকা মনে রাখেন নি। ‘খেলা যখন’ গল্পটির কাহিনী বুনন এই বইয়ের মধ্যে সবচেয়ে অযৌক্তিক বুনন বলে মনে হয়। কাহিনীতে চমক আনতে গিয়ে যুক্তি জাল ছিন্ন হয়ে গেছে বলে মনে হয়। সুজয়ের মতো শয়তান মানুষকে আত্মগ্লানিতে ভোগানোর জন্যে সব চরিত্রকে লেখিকা খুব মহান বানিয়েছেন। মৌমিতা সুজয়ের সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্কের কথা আগ বাড়িয়ে বলবে এবং তা শুনে বছরের পর বছর রুমেলা সুজয়ের সঙ্গে স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন যাপন করে যাবে, এটা বিশ্বাস যোগ্য নয়। তার চেয়েও অদ্ভুত নিজের স্বামীকে পরকীয়ার কথা জানালেও সুজয়ের বৌকে জানাবে কেন, তার কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যায়না।

সব মিলিয়ে ‘পাখিদের দ্বীপ’ বইটি অসাধারণ না হলেও পড়তে বেশ ভালো লাগে। সবাই যখন ছক ভাঙার পণ করে বিভিন্ন পর্বান্তরে কাহিনী বিন্যাস বা সার-রিয়েলিজম, ম্যাজিক রিয়েলিজমের ছকের মধ্যে আটকা পড়ে গেছেন, তখন সহজ কথা সহজ ভাবে বলার এই ধরন ভালো লাগে বৈকি!



পাখিদের দ্বীপ / সায়ন্তনী নাগ /নতুন শতক প্রকাশনী কলকাতা-৭০০০২৯

যোগাযোগঃ ৯৮৩০৯০৭৭৯২ 



3 comments:

  1. Replies
    1. valo review. tobe dhire dhire ro sahosi hoye uthte hobe somalochok ke.

      Delete
    2. valo review. tobe dhire dhire ro sahosi hoye uthte hobe somalochok ke.

      Delete