কাল ছিল ডাল খালি: গ্রামীণ রাজনীতির আবছায়ায় নাগরিক মননের বুনোট
অদিতি
ফাল্গুনী
তরুণ লেখক পাতাউর জামানের ‘কাল ছিল ডাল খালি’ পোস্টে যখন ঢাকায়
প্রথম হাতে পেলাম, প্রথম কয়েক পংক্তি পড়তে না পড়তে বুঝলাম লেখক আর কিছু না হোক গ্রাম
খুব চেনেন। চেনেন নিজস্ব করতলের মত। যে বিষয় নিয়ে তিনি লিখতে নেমেছেন, তা’ এত বেশি
চেনেন যে লেখার বিষয়ের সাথে অপরিচয়ের ঘাটতি ঢাকতে গিয়ে অধিকাংশ লেখকের মত অলঙ্কৃত শব্দ
বিন্যাস, উপমার আতিশয্য কিছু তার লেখায় পাওয়া যায় না। সাদামাটা, নিরলঙ্কার এবং নিরাভরণ
তাঁর গদ্য তুলট কাগজে কাঠকয়লার সামান্য কয়েকটি রেখায় আমাদের সামনে প্রকাশ করতে সক্ষম
হয় পশ্চিম বাংলার গ্রাম বিশেষত: মুসলিম গ্রাম জীবন। এ আখ্যান গ্রন্থ নিরুচ্চার মমতায়
ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে যে কোন সংখ্যালঘু জনপদের একান্ত যত দ্বিধা, সংশয় আর একদিকে সমাজের
গরিষ্ঠ স্রোতের সাথে মিশতে চাওয়ার বাসনা এবং সে বাসনা পূরণে যত ভয় ও সন্দেহ জনিত হতাশা।
জটিল এ মনস্তত্ব প্রায় ‘বিভূতিভূষণীয়’ সরলতায় উপস্থাপন করতে পেরেছেন এ তরুণ লেখক। ওপারের
সংখ্যালঘু হিসেবে এ মনস্তত্ব আমার খুব চেনা-
চেনা গরিষ্ঠের প্রতি এ ভয়, সন্দেহ আর নিরাশার দোলাচল!পাতাউরের লেখা নিয়ে যত্ন করে লিখতে
চাচ্ছিলাম বলে লিখতে অনেকটা দেরিও হয়ে গেল। তবে তাঁর লেখা নিয়ে লিখতে গেলে যত্নটা দরকার।
১৯৪৭-এ দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম এবং বাংলাদেশে হিন্দুরা
স্বাভাবিক ভাবে সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। সংখ্যালঘু মাত্রে নিজ অস্তিত্ব রক্ষা নিয়ে সদা চিন্তিত
এবং শঙ্কিত। সে শঙ্কা এ আখ্যানগ্রন্থের শুরু থেকে খুব সহজ ভঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলেছেন পাতাউর।
বাংলাদেশের হিন্দু যেমন, পশ্চিম বাংলার মুসলিমও তেমন। ক্রমাগত পিছু হঠা, পিছিয়ে পড়া
জীবন। যে জীবনে সাতগাছিয়ার মোল্লাপাড়ার জামিলা আলমের সাথে পালিয়ে যাওয়ায় গ্রামের সম্পন্ন
ভূস্বামী আকবর মোল্লার দলুজ (দহলিজ?) সালিশ সভায় বসে। জামিলার স্বামী বরকত স্ত্রীকে
না একটি শাড়ি, না ভাল খাবার না জৈবিক চাহিদা মেটানো- কিচ্ছু করতে পারেনা। সালিশ সভার
এক কোণায় বসা প্রেমিক আলম কাতর ভাবে জানান দেয়, ‘বিয়ে করব বলে পালিয়েছিলাম। পাক সারকাসের
বস্তিতে ট্যাঙ্গারির কাজ করে ঠিক চলে যাচ্ছিলো। কিন্ত্ত এ শালা বরকতের বাচ্চা-’আলম
বরকতের দিকে করুণামিশ্রিত চোখে কটমট করে তাকায়।তাকানোর ভঙ্গিটায় আর কিছু না হোক এই অর্থ বহন করছিল যে – তুই তো পারবিনা বরকত,দে না তিন তালাক বলে,দে না রেজাউল মাওলানার বিয়ে
পড়ানো খাতা থেকে তোর সাদিনামাটা ছিড়ে, দে না মুক্তি জামিলাকে। দিব্যি দিয়ে বলছি এই
গাঁয়ে থাকবো না। জামিলাকে নিয়ে পাকসারকাসে চলে যাব।ওখানে ট্যাঙারির কাজ করে খাবো।
বরকত কটমট করে চায় আলমের দিকে।’
এভাবে খুব সংক্ষেপে একটা সালিশ দৃশ্যের মাধ্যমে পশ্চিম বাংলার
মুসলিম গ্রামজীবনের ধারাবাহিক ছবি প্রতিষ্ঠা করতে থাকেন পাতাউর। তার আগে প্রথম দৃশ্যে
তিনি এঁকে ফেলেছেন গ্রামের হিন্দু-মুসলিম চাষীদের সাধারণ লোক জীবনের একটি রিচ্যুয়াল
‘পান্তা চুরি।’ পান্তা চুরিটি কেমন রিচ্যুয়ালস্? লেখকের ভাষায়, ‘প্রথাটা কোন আদিম কাল থেকে চলে আসছে জানা নেই রহিমদের।
দাদি প্রদাদিদের মুখ থেকে শুনে আসছে পান্তা চুরির কথা। জমিতে রোবার সময় পাশে পড়ে
থাকা পান্তা যদি পাশের জন চুরি করে খায়, তবে যাদের পান্তা যারা চুরি করেখেয়েছে
তাদের জমিতে রুয়ে দিতে হবে। আর যার জমিতে রোয়া হচ্ছে সে রাতে নেমতন্ন করে, মুরগি
জবাই করে সবাইকে পেট ভরে খাওয়াবে। পরের রাতে খাওয়ানোর ভার পড়বে বিপক্ষের জমি
মালিকের উপর।
সাবু নেমে ছিল পান্তা
চুরিতে । কোমরের গামছা মাথার পাগড়ি হয়ে, তার সাথে ধানের শিস গুজে সবাই রাজা
সেজেছিল। একদল যখন পান্তা চুরি করে গামলা টেনে আনছিলো, অপর দল হাঁকিয়ে ওঠে, এতক্ষণ
বুঝতে পেরেছে পান্তা চুরির খেলা হচ্ছে –
হেই হেই চুরি করস ক্যানো ভাই
জমি নাই,ধান নাই ওই টুকু মোদের ঠাই।
অপর দল দমকে দমকে
এগিয়ে আসে -
তা রাহখিস ক্যানো ভাই যখন রাখার সাধ্যি নাই
পির আওলিয়া কয়েগেছে ছাড়তে হবে ভাই
ছন্দে দন্দে এক দল
এগিয়ে আসে, ছন্দে দন্দে একদল পিছোয়। মাঠের সদ্য রোয়া ধানের শিষ গুলো রঙ্গ দেখে।’
পাতাউরের লেখনীতে
পান্তা চুরির এ রিচ্যুয়ালের বিবরণ মনে করিয়ে দেয় চৈনিক লেখক লু স্যুনের লেখায়
চাঁদনী রাতে চীনের কৃষক পরিবারের শিশু-কিশোরদের মটরশুঁটি চুরি করে খাওয়ার গল্প।
তেম্নি সরস সহজতা।
এ আখ্যানে প্রধান কয়েকটি চরিত্রের দু’জন হলো গ্রামীন অভিজাত
আকবর মোল্লার শহরে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে আজাদ আর গ্রামের সাধারণ কৃষক যুবক সাবু।
আর একটি প্রধান চরিত্র আজাদের দাদিমা বা পিতামহী।লেখকের হাল্কা কৌতুক মেশানো বয়ানে,
‘আকবর মোল্লার সাধ ছিল বংশে একজন সরকারি চাকরি করুক। আকবর মোল্লা,এই মাছ পাড়া শুদ্ধু ক্যানো, এলাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধনী
ব্যাক্তি। নিজস্ব দুখানা পুকুর, ঘেরি, বিঘে চল্লিশের উপর জমি,দোতলা বাড়ি। বাড়ির
সামনেসান বাঁধানো পুকুর। মেয়ে নেই। আজাদ, এক ছেলে।দাদির সাধ ছিল নাতি ডাক্তার
পড়ুক। মরার সময় নাতির হাতের ইনজেকশন নিয়ে সুস্থ হবে। কিন্তু সেই নাতি,
উচ্চমাধ্যমিকে খারাপ রেজাল্ট করে আর
জয়েন্ট দিল না। কলকাতায় গেলো ইংরেজি নিয়ে পড়াশুন করতে। আকবরের ফ্যামিলিতে প্রথম বি.এ. অনার্স
পড়তে যাওয়া কেউ।’
শহর থেকে এসেছে যে
আজাদ তাকে নিয়ে গ্রামে জোর গুজব যে সে শহরে কোন হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করেছে। আজাদের
মা অবধি আজাদকে নিয়ে চিন্তিত। ছেলে উদাস মুখে থাকে, বিড়ি খায় আর বাড়ির ল্যাণ্ড
সেটে কে যেন ফোন করে। অন্য কেউ ধরলে কেটে দেয়। গ্রামের কিষাণ সাবুকে আজাদের মা
অনুরোধ করেন তার ছেলেকে একটু সঙ্গ দিতে।
আখ্যানের তৃতীয়
অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি নায়ক আজাদ পদ্মার বিলে যাচ্ছে।আজাদের অবস্থা এখানে ‘পুতুল
নাচের ইতিকথা’র শশী ডাক্তারের মত। গ্রামের অনেক মানুষের ভিড়ে সে নি:সঙ্গ। নগরায়ণ
বা পশ্চিমা শিক্ষার আলোকায়ন তাকে বিচ্ছিন্ন করেছে তার স্বজনদের কাছ থেকে।স্বগোত্র
থেকে এ বিচ্ছিন্নতা কত যে ভয়াবহ তা’ বোঝা যায় আখ্যানে পদ্মার বিল পাড়ে বেড়াতে গিয়ে
সেখানে আজাদের প্রতি ছেলেবেলার বন্ধু রেজাউলের কিছু প্রশ্নে।
‘আজাদ রেজাউলের আগে
আগে হাঁটে। সাবু পিছনে পিছনে।
-
তা কোলকাতায় ক্যামন
আছিস? নামাজ টামাজ পড়িস তো? না হিঁদু হয়ে গেছিস!
আজাদ হাসে।
-
আমাদের গ্রামে তুই
প্রথম সরকারি চাকরি করা ছেলে হবি। তাও মুসলমান। আচ্ছা কোলকাতার মুসলমানরা দাঁড়িয়ে
না বসে ওটা করে? ওখানে শুনেছি সরকারি বাথরুম গুলোতে নাকি সব দাঁড়িয়ে মোতার জায়গা
করা আছে।
-
ধুর ছাড় তো ওসব।
আজাদ হাসে। মনটা
বিষন্ন হয়। কি হবে এদের!’
আখ্যানের এ জায়গায়
সংলাপের তীক্ষতা যে কোন সংবেদনশীল পাঠককে বিদ্ধ করবে। ভাবতে বাধ্য করবে একটি দেশের
অত্যন্ত পিছিয়ে থাকা একটি জন-সম্প্রদায়ের মানসলোকের দিশাহারা তমসাচ্ছন্নতা
সম্বন্ধে।
পদ্মার ঝিলের বিবরণও
দারুণ এঁকেছেন লেখক। এককালে পদ্মার শাখা নদী দিয়ে চন্দ্রকেতু রাজা এসে বেড়াচাপা জয়
করেছিলো। গোরাচাদের সাথে হেরে যাওয়ার দুঃখে সেই যে মজতে শুরু করেছিল, আজ সেই পদ্মা
ঝিলে পরিণত হয়েছে। এক পারে মোল্লা পাড়া, আর এক পারে সদ্দারপাড়া। দূর থেকে দেখলে
মনে হয় হিন্দুস্থান –
পাকিস্থান। এপারে মসজিদের আজান তো ওপারে মন্দিরের ঘণ্টার ধ্বনি। পাল্লা দিয়ে,
পাল্লা করে উভয় উভয়কে উত্তর দেয়। ঠিক যেমন অবুঝরা করে। বুঝবে না জেনেও খুব বুজেছে
বোঝার ভান করে।
যোগাযোগ বলতে জমির আল, তাও প্রত্যেক বছর চাষের সময় এক কোদাল করে কমে
যাচ্ছে। ঐ আল দিয়ে ডিম ওয়ালা, ডাবওয়ালা, দুধ ওয়ালা, ফুলঝাড়ুর ফেরি, ল’ওয়ালার কটকটি ভাজা –দুই পাড়ের মধ্যে সংযোগ বজায় রাখে।
সরল, নিরাভরণ অথচ তীব্র আবেগময় গদ্যে পাতাউর আমাদের চেনাতে থাকেন পশ্চিম
বাংলার মুসলিম গ্রামজীবন।কচি ধানের শিসের দুধ থেকে শুরু করে মোল্লাপাড়ার
সামনের ইসাকের চায়ের দোকানে তিন ঘন্টা ভিসিআরে
সিনেমা দেখার জন্য দাম হিসেবে টিকিটের বদলে কমপক্ষে তিন কাপ চা ও তিনটে জবা
বিস্কুট খাবার কঠোর নিয়মের বয়ান পাঠককে না হাসিয়ে পারেনা। মুসলিমপ্রধান সে গ্রামে
টিভিতে সিনেমা শেষ হবার পর সংবাদে ইরাকের
উপর আমেরিকার বোমা আক্রমণ ও হতাহতের সংবাদ চিত্রে গ্র্রামের মানুষের ক্ষোভ দারুণ
ভাবে ডিল করেছেন লেখক: শালা কাফেরের বাচ্চা। ক্যামন করে মোসলমান গুলোকে মেরতেছে
দ্যাখ না।
যা না হুমদো মুখো, নিজেদের দেশের মাগিদের কাছে গিয়ে মর। ক্যানো আমাদের
মুসলিম ভাইদের ধরে মেরতিচিস!’
আখ্যানের পঞ্চম অধ্যায়ে ব্যক্তি আজাদের মানসিক টানা-পোড়েন
পাঠকের জন্য বিশদ উপস্থাপনা করেন লেখক।এক দিকে ফেলে আসা শহরের নানা ঘটনা আর একদিকে
গ্রামে স্বগোত্রের মানুষ। কারো সাথে যেন আজাদ নিজেকে মেলাতে পারে না।শহরের হিন্দু প্রেমিকা
আল্পনা সাহার কথা ভাবে। ভাবে শহরে সে নিজে বা তার মত অন্য মফস্বলী বন্ধুদের শহরের তুখোড়
বন্ধুদের হাতে ব্যবহৃত হবার কথা। আর এদিকে গ্রামীণ রাজনীতিতে আজাদের বাবার বিরুদ্ধে
প্রতিপক্ষ তাঁর (আকবার মোল্লার) ছেলের (আজাদের) হিন্দু মেয়ে বিয়ের অভিযোগের গুজব ছড়ানো
চলতে থাকে। এমন দ্বিবিধ সঙ্কটের ভেতর উদ্ধার হয়ে আসে আজাদের পিতামহী বা দাদিমা। প্রাতিষ্ঠানিক
শিক্ষা না থাকা এ বৃদ্ধা জীবনের ভুয়ো জ্ঞানে প্রজ্ঞাবতী। নাতিকে তিনি বোঝান: ‘বলছি গত ছয় বছর ধরে বাড়ির সাথে ঠিক কোন খানে সম্পর্ক ধরে
রেখেছো শুনি! বছরে একবার বাড়িতে আস্তে। তাও জোর করে,ঠিক ঈদের আগের দিনে। পরের পরের
দিন আবার চলে যেতে। ছ’বছরে, আমার কথা ছেড়ে দাও, আমি বুড়ো হাবড়া মানুষ,
ছেলের কোন দায়িত্বটা পালন করেছো? বা গ্রামের প্রতি? আজ গ্রামের ঐ মোটা বুদ্ধি
মানুষ, তোমার মতে, গাছ পালা, পরিবার তোমাকে আপন করে নেবে – ভাবলে কি করে।’
আজাদের প্রেমিকার
অন্তিমে প্রেমের চূড়ান্ত পরিণতি দিতে অনাগ্রহের বেদনাও আজাদকে শান্ত ভাবে মেনে
নেবার ধীরতা দান করেন প্রজ্ঞাময়ী পিতামহী। আখ্যানের অন্তিমে নায়ক তাঁর গোটা
জীবনাভিজ্ঞতার বেদনাকে শান্ত ভাবে গ্রহণে সক্ষম হন এ পিতামহীর উপদেশে।
আগাগোড়া সুলিখিত এ
আখ্যান যেন শুরু থেকে বিকশিত হবার একটা বিন্দু অবধি গিয়ে সহসা শেষ হয়ে যায়। লেখক
যেন স্থির নিশ্চিত হতে পারেন নি এটি গল্প আকারে রেখে দিবেন না উপন্যাস হিসেবে শেষ
করবেন! গ্রামীণ রাজনীতি বা আজাদ চরিত্রের আরো নানা বাঁক দেখানো যেত। যাহোক, যতটুকু
করেছেন পাতাউর জামান, সেটা বা কম কি? তাঁকে স্বাগত।
তরুণ লেখক পাতাউর জামানের ‘কাল ছিল ডাল খালি’ পোস্টে যখন ঢাকায়
প্রথম হাতে পেলাম, প্রথম কয়েক পংক্তি পড়তে না পড়তে বুঝলাম লেখক আর কিছু না হোক গ্রাম
খুব চেনেন। চেনেন নিজস্ব করতলের মত। যে বিষয় নিয়ে তিনি লিখতে নেমেছেন, তা’ এত বেশি
চেনেন যে লেখার বিষয়ের সাথে অপরিচয়ের ঘাটতি ঢাকতে গিয়ে অধিকাংশ লেখকের মত অলঙ্কৃত শব্দ
বিন্যাস, উপমার আতিশয্য কিছু তার লেখায় পাওয়া যায় না। সাদামাটা, নিরলঙ্কার এবং নিরাভরণ
তাঁর গদ্য তুলট কাগজে কাঠকয়লার সামান্য কয়েকটি রেখায় আমাদের সামনে প্রকাশ করতে সক্ষম
হয় পশ্চিম বাংলার গ্রাম বিশেষত: মুসলিম গ্রাম জীবন। এ আখ্যান গ্রন্থ নিরুচ্চার মমতায়
ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে যে কোন সংখ্যালঘু জনপদের একান্ত যত দ্বিধা, সংশয় আর একদিকে সমাজের
গরিষ্ঠ স্রোতের সাথে মিশতে চাওয়ার বাসনা এবং সে বাসনা পূরণে যত ভয় ও সন্দেহ জনিত হতাশা।
জটিল এ মনস্তত্ব প্রায় ‘বিভূতিভূষণীয়’ সরলতায় উপস্থাপন করতে পেরেছেন এ তরুণ লেখক। ওপারের
সংখ্যালঘু হিসেবে এ মনস্তত্ব আমার খুব চেনা-
চেনা গরিষ্ঠের প্রতি এ ভয়, সন্দেহ আর নিরাশার দোলাচল!পাতাউরের লেখা নিয়ে যত্ন করে লিখতে
চাচ্ছিলাম বলে লিখতে অনেকটা দেরিও হয়ে গেল। তবে তাঁর লেখা নিয়ে লিখতে গেলে যত্নটা দরকার।
১৯৪৭-এ দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম এবং বাংলাদেশে হিন্দুরা
স্বাভাবিক ভাবে সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। সংখ্যালঘু মাত্রে নিজ অস্তিত্ব রক্ষা নিয়ে সদা চিন্তিত
এবং শঙ্কিত। সে শঙ্কা এ আখ্যানগ্রন্থের শুরু থেকে খুব সহজ ভঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলেছেন পাতাউর।
বাংলাদেশের হিন্দু যেমন, পশ্চিম বাংলার মুসলিমও তেমন। ক্রমাগত পিছু হঠা, পিছিয়ে পড়া
জীবন। যে জীবনে সাতগাছিয়ার মোল্লাপাড়ার জামিলা আলমের সাথে পালিয়ে যাওয়ায় গ্রামের সম্পন্ন
ভূস্বামী আকবর মোল্লার দলুজ (দহলিজ?) সালিশ সভায় বসে। জামিলার স্বামী বরকত স্ত্রীকে
না একটি শাড়ি, না ভাল খাবার না জৈবিক চাহিদা মেটানো- কিচ্ছু করতে পারেনা। সালিশ সভার
এক কোণায় বসা প্রেমিক আলম কাতর ভাবে জানান দেয়, ‘বিয়ে করব বলে পালিয়েছিলাম। পাক সারকাসের
বস্তিতে ট্যাঙ্গারির কাজ করে ঠিক চলে যাচ্ছিলো। কিন্ত্ত এ শালা বরকতের বাচ্চা-’আলম
বরকতের দিকে করুণামিশ্রিত চোখে কটমট করে তাকায়।তাকানোর ভঙ্গিটায় আর কিছু না হোক এই অর্থ বহন করছিল যে – তুই তো পারবিনা বরকত,দে না তিন তালাক বলে,দে না রেজাউল মাওলানার বিয়ে
পড়ানো খাতা থেকে তোর সাদিনামাটা ছিড়ে, দে না মুক্তি জামিলাকে। দিব্যি দিয়ে বলছি এই
গাঁয়ে থাকবো না। জামিলাকে নিয়ে পাকসারকাসে চলে যাব।ওখানে ট্যাঙারির কাজ করে খাবো।
বরকত কটমট করে চায় আলমের দিকে।’
এভাবে খুব সংক্ষেপে একটা সালিশ দৃশ্যের মাধ্যমে পশ্চিম বাংলার
মুসলিম গ্রামজীবনের ধারাবাহিক ছবি প্রতিষ্ঠা করতে থাকেন পাতাউর। তার আগে প্রথম দৃশ্যে
তিনি এঁকে ফেলেছেন গ্রামের হিন্দু-মুসলিম চাষীদের সাধারণ লোক জীবনের একটি রিচ্যুয়াল
‘পান্তা চুরি।’ পান্তা চুরিটি কেমন রিচ্যুয়ালস্? লেখকের ভাষায়, ‘প্রথাটা কোন আদিম কাল থেকে চলে আসছে জানা নেই রহিমদের।
দাদি প্রদাদিদের মুখ থেকে শুনে আসছে পান্তা চুরির কথা। জমিতে রোবার সময় পাশে পড়ে
থাকা পান্তা যদি পাশের জন চুরি করে খায়, তবে যাদের পান্তা যারা চুরি করেখেয়েছে
তাদের জমিতে রুয়ে দিতে হবে। আর যার জমিতে রোয়া হচ্ছে সে রাতে নেমতন্ন করে, মুরগি
জবাই করে সবাইকে পেট ভরে খাওয়াবে। পরের রাতে খাওয়ানোর ভার পড়বে বিপক্ষের জমি
মালিকের উপর।
সাবু নেমে ছিল পান্তা
চুরিতে । কোমরের গামছা মাথার পাগড়ি হয়ে, তার সাথে ধানের শিস গুজে সবাই রাজা
সেজেছিল। একদল যখন পান্তা চুরি করে গামলা টেনে আনছিলো, অপর দল হাঁকিয়ে ওঠে, এতক্ষণ
বুঝতে পেরেছে পান্তা চুরির খেলা হচ্ছে –
হেই হেই চুরি করস ক্যানো ভাই
জমি নাই,ধান নাই ওই টুকু মোদের ঠাই।
অপর দল দমকে দমকে
এগিয়ে আসে -
তা রাহখিস ক্যানো ভাই যখন রাখার সাধ্যি নাই
পির আওলিয়া কয়েগেছে ছাড়তে হবে ভাই
ছন্দে দন্দে এক দল
এগিয়ে আসে, ছন্দে দন্দে একদল পিছোয়। মাঠের সদ্য রোয়া ধানের শিষ গুলো রঙ্গ দেখে।’
পাতাউরের লেখনীতে
পান্তা চুরির এ রিচ্যুয়ালের বিবরণ মনে করিয়ে দেয় চৈনিক লেখক লু স্যুনের লেখায়
চাঁদনী রাতে চীনের কৃষক পরিবারের শিশু-কিশোরদের মটরশুঁটি চুরি করে খাওয়ার গল্প।
তেম্নি সরস সহজতা।
এ আখ্যানে প্রধান কয়েকটি চরিত্রের দু’জন হলো গ্রামীন অভিজাত
আকবর মোল্লার শহরে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে আজাদ আর গ্রামের সাধারণ কৃষক যুবক সাবু।
আর একটি প্রধান চরিত্র আজাদের দাদিমা বা পিতামহী।লেখকের হাল্কা কৌতুক মেশানো বয়ানে,
‘আকবর মোল্লার সাধ ছিল বংশে একজন সরকারি চাকরি করুক। আকবর মোল্লা,এই মাছ পাড়া শুদ্ধু ক্যানো, এলাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধনী
ব্যাক্তি। নিজস্ব দুখানা পুকুর, ঘেরি, বিঘে চল্লিশের উপর জমি,দোতলা বাড়ি। বাড়ির
সামনেসান বাঁধানো পুকুর। মেয়ে নেই। আজাদ, এক ছেলে।দাদির সাধ ছিল নাতি ডাক্তার
পড়ুক। মরার সময় নাতির হাতের ইনজেকশন নিয়ে সুস্থ হবে। কিন্তু সেই নাতি,
উচ্চমাধ্যমিকে খারাপ রেজাল্ট করে আর
জয়েন্ট দিল না। কলকাতায় গেলো ইংরেজি নিয়ে পড়াশুন করতে। আকবরের ফ্যামিলিতে প্রথম বি.এ. অনার্স
পড়তে যাওয়া কেউ।’
শহর থেকে এসেছে যে
আজাদ তাকে নিয়ে গ্রামে জোর গুজব যে সে শহরে কোন হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করেছে। আজাদের
মা অবধি আজাদকে নিয়ে চিন্তিত। ছেলে উদাস মুখে থাকে, বিড়ি খায় আর বাড়ির ল্যাণ্ড
সেটে কে যেন ফোন করে। অন্য কেউ ধরলে কেটে দেয়। গ্রামের কিষাণ সাবুকে আজাদের মা
অনুরোধ করেন তার ছেলেকে একটু সঙ্গ দিতে।
আখ্যানের তৃতীয়
অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি নায়ক আজাদ পদ্মার বিলে যাচ্ছে।আজাদের অবস্থা এখানে ‘পুতুল
নাচের ইতিকথা’র শশী ডাক্তারের মত। গ্রামের অনেক মানুষের ভিড়ে সে নি:সঙ্গ। নগরায়ণ
বা পশ্চিমা শিক্ষার আলোকায়ন তাকে বিচ্ছিন্ন করেছে তার স্বজনদের কাছ থেকে।স্বগোত্র
থেকে এ বিচ্ছিন্নতা কত যে ভয়াবহ তা’ বোঝা যায় আখ্যানে পদ্মার বিল পাড়ে বেড়াতে গিয়ে
সেখানে আজাদের প্রতি ছেলেবেলার বন্ধু রেজাউলের কিছু প্রশ্নে।
‘আজাদ রেজাউলের আগে
আগে হাঁটে। সাবু পিছনে পিছনে।
-
তা কোলকাতায় ক্যামন
আছিস? নামাজ টামাজ পড়িস তো? না হিঁদু হয়ে গেছিস!
আজাদ হাসে।
-
আমাদের গ্রামে তুই
প্রথম সরকারি চাকরি করা ছেলে হবি। তাও মুসলমান। আচ্ছা কোলকাতার মুসলমানরা দাঁড়িয়ে
না বসে ওটা করে? ওখানে শুনেছি সরকারি বাথরুম গুলোতে নাকি সব দাঁড়িয়ে মোতার জায়গা
করা আছে।
-
ধুর ছাড় তো ওসব।
আজাদ হাসে। মনটা
বিষন্ন হয়। কি হবে এদের!’
আখ্যানের এ জায়গায়
সংলাপের তীক্ষতা যে কোন সংবেদনশীল পাঠককে বিদ্ধ করবে। ভাবতে বাধ্য করবে একটি দেশের
অত্যন্ত পিছিয়ে থাকা একটি জন-সম্প্রদায়ের মানসলোকের দিশাহারা তমসাচ্ছন্নতা
সম্বন্ধে।
পদ্মার ঝিলের বিবরণও
দারুণ এঁকেছেন লেখক। এককালে পদ্মার শাখা নদী দিয়ে চন্দ্রকেতু রাজা এসে বেড়াচাপা জয়
করেছিলো। গোরাচাদের সাথে হেরে যাওয়ার দুঃখে সেই যে মজতে শুরু করেছিল, আজ সেই পদ্মা
ঝিলে পরিণত হয়েছে। এক পারে মোল্লা পাড়া, আর এক পারে সদ্দারপাড়া। দূর থেকে দেখলে
মনে হয় হিন্দুস্থান –
পাকিস্থান। এপারে মসজিদের আজান তো ওপারে মন্দিরের ঘণ্টার ধ্বনি। পাল্লা দিয়ে,
পাল্লা করে উভয় উভয়কে উত্তর দেয়। ঠিক যেমন অবুঝরা করে। বুঝবে না জেনেও খুব বুজেছে
বোঝার ভান করে।
যোগাযোগ বলতে জমির আল, তাও প্রত্যেক বছর চাষের সময় এক কোদাল করে কমে
যাচ্ছে। ঐ আল দিয়ে ডিম ওয়ালা, ডাবওয়ালা, দুধ ওয়ালা, ফুলঝাড়ুর ফেরি, ল’ওয়ালার কটকটি ভাজা –দুই পাড়ের মধ্যে সংযোগ বজায় রাখে।
সরল, নিরাভরণ অথচ তীব্র আবেগময় গদ্যে পাতাউর আমাদের চেনাতে থাকেন পশ্চিম
বাংলার মুসলিম গ্রামজীবন।কচি ধানের শিসের দুধ থেকে শুরু করে মোল্লাপাড়ার
সামনের ইসাকের চায়ের দোকানে তিন ঘন্টা ভিসিআরে
সিনেমা দেখার জন্য দাম হিসেবে টিকিটের বদলে কমপক্ষে তিন কাপ চা ও তিনটে জবা
বিস্কুট খাবার কঠোর নিয়মের বয়ান পাঠককে না হাসিয়ে পারেনা। মুসলিমপ্রধান সে গ্রামে
টিভিতে সিনেমা শেষ হবার পর সংবাদে ইরাকের
উপর আমেরিকার বোমা আক্রমণ ও হতাহতের সংবাদ চিত্রে গ্র্রামের মানুষের ক্ষোভ দারুণ
ভাবে ডিল করেছেন লেখক: শালা কাফেরের বাচ্চা। ক্যামন করে মোসলমান গুলোকে মেরতেছে
দ্যাখ না।
যা না হুমদো মুখো, নিজেদের দেশের মাগিদের কাছে গিয়ে মর। ক্যানো আমাদের
মুসলিম ভাইদের ধরে মেরতিচিস!’
আখ্যানের পঞ্চম অধ্যায়ে ব্যক্তি আজাদের মানসিক টানা-পোড়েন
পাঠকের জন্য বিশদ উপস্থাপনা করেন লেখক।এক দিকে ফেলে আসা শহরের নানা ঘটনা আর একদিকে
গ্রামে স্বগোত্রের মানুষ। কারো সাথে যেন আজাদ নিজেকে মেলাতে পারে না।শহরের হিন্দু প্রেমিকা
আল্পনা সাহার কথা ভাবে। ভাবে শহরে সে নিজে বা তার মত অন্য মফস্বলী বন্ধুদের শহরের তুখোড়
বন্ধুদের হাতে ব্যবহৃত হবার কথা। আর এদিকে গ্রামীণ রাজনীতিতে আজাদের বাবার বিরুদ্ধে
প্রতিপক্ষ তাঁর (আকবার মোল্লার) ছেলের (আজাদের) হিন্দু মেয়ে বিয়ের অভিযোগের গুজব ছড়ানো
চলতে থাকে। এমন দ্বিবিধ সঙ্কটের ভেতর উদ্ধার হয়ে আসে আজাদের পিতামহী বা দাদিমা। প্রাতিষ্ঠানিক
শিক্ষা না থাকা এ বৃদ্ধা জীবনের ভুয়ো জ্ঞানে প্রজ্ঞাবতী। নাতিকে তিনি বোঝান: ‘বলছি গত ছয় বছর ধরে বাড়ির সাথে ঠিক কোন খানে সম্পর্ক ধরে
রেখেছো শুনি! বছরে একবার বাড়িতে আস্তে। তাও জোর করে,ঠিক ঈদের আগের দিনে। পরের পরের
দিন আবার চলে যেতে। ছ’বছরে, আমার কথা ছেড়ে দাও, আমি বুড়ো হাবড়া মানুষ,
ছেলের কোন দায়িত্বটা পালন করেছো? বা গ্রামের প্রতি? আজ গ্রামের ঐ মোটা বুদ্ধি
মানুষ, তোমার মতে, গাছ পালা, পরিবার তোমাকে আপন করে নেবে – ভাবলে কি করে।’
আজাদের প্রেমিকার
অন্তিমে প্রেমের চূড়ান্ত পরিণতি দিতে অনাগ্রহের বেদনাও আজাদকে শান্ত ভাবে মেনে
নেবার ধীরতা দান করেন প্রজ্ঞাময়ী পিতামহী। আখ্যানের অন্তিমে নায়ক তাঁর গোটা
জীবনাভিজ্ঞতার বেদনাকে শান্ত ভাবে গ্রহণে সক্ষম হন এ পিতামহীর উপদেশে।
আগাগোড়া সুলিখিত এ
আখ্যান যেন শুরু থেকে বিকশিত হবার একটা বিন্দু অবধি গিয়ে সহসা শেষ হয়ে যায়। লেখক
যেন স্থির নিশ্চিত হতে পারেন নি এটি গল্প আকারে রেখে দিবেন না উপন্যাস হিসেবে শেষ
করবেন! গ্রামীণ রাজনীতি বা আজাদ চরিত্রের আরো নানা বাঁক দেখানো যেত। যাহোক, যতটুকু
করেছেন পাতাউর জামান, সেটা বা কম কি? তাঁকে স্বাগত।
আমার একটা প্রশ্ন আছে। পান্তাচুরির যে বর্ণনা নভলেটটিতে রয়েছে তা কি বাস্তবানুগ ?
ReplyDeleteBastobanug bolte ki bolte caichen? Mane eta ki bastobe ghate ki na!ha eta ghate.lokosanskriti te eti ekti lupto krisi khala. Jar kastheke niyechi tini holen amar nijer thakuma.nam sunduri bibi. Baos 91 yrs
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteআচ্ছা। জানানোর জন্য ধন্যবাদ। :)
ReplyDelete