Tuesday, July 5, 2016

সন্ত নিকোলাসের হাড়গোড় / অনির্বাণ ভট্টাচার্য



কবিতার অনির্বাণ হাড়গোড়


বৈদূর্য্য সরকার


উৎসর্গ পত্রে অনির্বাণ লিখেছে “মৃত্যু নিবি না?” পড়ে কি থমকে যাইনি ! বইটা হাতে নিয়েও কম অবাক হইনি, সেঁজুতি দাশগুপ্তের প্রচ্ছদের কারণে । লাল রঙটাকে যে এভাবেও ব্যবহার করা যায়, সেটা দেখে । শুভ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশিত বইটির প্রোডাকশানের মান প্রশংসনীয় । হয়তো অনির্বাণের আত্মবিশ্বাস ছিল, শোভিত বুকশেলফে জায়গা পাবে তার বই । কিন্তু সেটা যে তার গন্তব্য নয় কবি বুঝিয়ে দেন মুখবন্ধে নামহীন কবিতার  দ্বিতীয় স্তবকে-

“আশ্চর্য ভাতের গন্ধ গোটা দেশ জুড়ে
 তেতো শেকড়ের স্বাদ, পিঁপড়ের ডিম খেয়ে বাঁচা 
 সারি সারি মানুষের রেবেল...
 তোকে কালাহান্ডি নামে ডাকলে কতজন বুভুক্ষু সাড়া দেবে?”

সমাজতন্ত্র কিংবা জীবনানন্দের কবিতা, যৌথখামারের স্বপ্ন কিংবা মৃত্যুর স্বাদ কোথাও মিলেমিশে যায় অনির্বাণের অধুনান্তিক কবিতায় । 

“হে ঈশ্বর, দেখে গেলে না
 এ শহর আবার গর্জে উঠছে
 বিপ্লবে বা চৈত্র সেলে।”

... পড়ে মনে হয় বাজার সর্বস্ব দুনিয়ায় পরম শক্তিশালী বাজার অর্থনীতিকে কবি এড়াতে পারেনি, যেমন ভুলতে পারেনি পেছনে পড়ে থাকা মনে করা লোকেদের গ্লানি –

“পড়ে থাকি আমরা,
 যারা উৎসবের রাতে
 নিজস্ব নারীকে দেখেও ভালোবাসতে পারি না ...”

‘বছর শেষের রাতে’ কবি শোনে অবহমানের ডাক- “বাইরে প্রতীক্ষমাণ তুমি, আসছে ও আসছে” । কবি ‘কোথাও একটা’ নিশ্চিন্ত জীবনের আশায় থাকে, খেয়েপড়ে থাকার সেই শাশ্বত গল্পের খোঁজে থাকে, তবু কোথাও যেন আশ্রয় মেলে না-

“আমিও কাঙাল, একথালা ভাত ঈশারায়
 ভেতরে ডাকছি, ছিটকিনি তুলে দিস। ”

কবির ‘ভাতের গন্ধ ইচ্ছে করে’ কিন্তু সে গন্ধে মিশে যায় রক্ত যৌনতা কিংবা সামাজিক মুক্তির গল্প –

“দু-মুঠো ভাতের ঘ্রাণে ঢেলে দেব
 তোর শরীর খারাপের রক্ত ।”

 ‘ভালোটি আছি’ লিখেও কবি আসলে ভালো থাকে না । সামাজিক উদাসীনতায় জীবন তাকে বাধ্য করে লিখতে –
“ততটাই কাতর আমার চিৎকার
 অথচ দ্যাখো, কীরকম চুপটি হয়ে গেছি...”

‘সেই অসুখী লোকটা’র কবি আসলে  শূন্যতাকে নিয়তি ভেবে, না পাওয়াকে নির্দিষ্ট ভেবে নির্লিপ্ত উচ্চারণে বলে ওঠেন –
“ঝুট হ্যায়, সব ঝুট হ্যায়”

বলার অপেক্ষা রাখে না কবির গেরস্থালিতে মেশে প্রেম, শরীর,  সম্পর্কে উদাসীনতা নয় খুঁজে পাওয়া যায় গভীর আশ্লেষ

“তোকে নগ্ন করে,
 শেখাব গলা দিয়ে ভাত, মাসমাইনে
 অথবা পুরুষাকার... কোথায় কতটা ঢোকে”

কবি বোঝেননি গারস্থের সমীকরণ, কখনও উদাসীন থেকেছেন মাত্রার হিসেবনিকেশে তবু বুঝেছেন পারিপার্শ্ব তাকে পুতুলখেলা রান্নাবাটির জগতে কিভাবে গিলে ফেলে আস্তে আস্তে -

“অক্ষরবৃত্তে আমার হাঁটা হয়নি ঠিকমতো
 তবে হেঁটে গেছে গেরস্থালীর পোকারা
 আমার তেলচিটচিটে পৃথিবীতে ...”

তাই মায়ায় জড়ানো জিবের মতো মনে স্বাভাবিক বংশগতির তত্ত্ব উঠে আসে, ছাপোষা পিতার জিজ্ঞাসায় সে প্রশ্ন করে
“ও কি আর আমার মতো হবে?”

কবির মন পরে থাকে কৈশোরের স্বপ্নে, উল্টো দিকে ছুটে  ফিরে পেতে চায় শারদীয়ার গল্প –

“সেই কবে মরে গেছে কিকিরা
 আর কাকাবাবু হলদে চোখে দরদাম করছেন”

ব্যাক কভারে কবির সংক্ষিপ্ত জীবনী থেকে জানা যায় ৮৩’ তে চন্দননগরে জন্ম,বিশ্বভারতী ও যাদবপুরে শিক্ষা, প্রসার ভারতীতে বর্তমানে কর্মরত । এছাড়াও তার লেখালিখি সখ আহ্লাদ ইত্যাদি। বোঝা যায় এটা নতুন গড়ে ওঠা প্রকাশনীর বিপণন কৌশল। কারণ পাঠকের কাছে এসব গৌণ হয়ে যায় কবি যখন প্রথম ‘ক্রিসমাসের কবিতা’য় তৃতীয় বিশ্বকে মিশিয়ে দেয় ইতিহাস কিংবা মিথের সাথে, হয়ত কিছুটা মনকেমনের  অভিব্যক্তিতে – “টান পড়ছে গল্পে, সাবেকি ঠাম্মাদের ছেড়ে ...” এখানে বোধহয় কবির ব্যক্তিগত কিছু অপ্রাপ্তিও মিশে থাকে, ‘রূপকথার গল্পে’ সব রেফারেন্সে অনুপস্থিত থাকে বাংলার নিজস্ব কথা । পালা পার্বণের ক্ষেত্রেও অবচেতনে কবি এড়িয়ে যান বাংলাকে। অথচ অনেক ভুলে যাওয়া ছবি কিভাবে যেন থেকে যায় অতীতের মতো স্মৃতি হয়ে, যে ছবি নগর সভ্যতায় হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ –

“শ্যাওলার মতো সন্ধে নামে তুলসীতলায়,
 মায়ের গলায় বাবার অসুখ,

না গাওয়া গান”... এ সবকিছু নিয়ে কবিকে বসে থাকতে হয় জীবনের অভিলাষে কারণ সৃষ্টির সাথে কোথাও বোধহয় অপেক্ষাও মিশে থাকে স্বভাবত –

“আমি একফালি ওম ধরে বসে আছি-
 এ উত্তাপ আমার একার।”

কবিকে মনে হয় অতীতচারী...সব কিছু ফিরে ফিরে আসে ... কখনো স্কুল জীবনের বন্ধু কিংবা কৈশোরের ইদিপাস  আসে স্বপ্নের মতো ‘আত্মহত্যার রাতে’ 

“পুজোর জামা আর পাউডার-ঘাড় ঘুরিয়ে
 বাবার সাথে তোমাকে হাঁটতে দেখে”
 মনে মনে ইদিপাস ইদিপাস খেলছি... ”

অনির্বাণের কবিতা সমকালীন হয়েও কোথায় যেন আবহমানের কথা বলে, জীবনযাপনের দীর্ঘ পরিক্রমার কথা বলে, সেটা বলে নিজস্ব ভঙ্গিতে কিন্তু তাতে মিশে থাকে সাবেকি কিছু ভাবনা, না ভুলতে পারা কিছু দৃশ্যকল্প । ভারতীয়  তত্ত্বকে অন্তত দৃশ্যে অস্বীকার করতে পারেন না কবি, কোথাও যেন সমকাল সামাজিকতা কিংবা রাজনীতি তাকে ঘিরে রাখে – 

“চেঁচিয়ে বলিনি,
বিপ্লবী, কর্মসূচি থেকে বিপ্লব সরালে কেন?
আর তুমি কিনা এখনই
হাত থেকে সিঁদুর ফেলে দিয়ে
থর থর করে কেঁপে উঠলে ...? ”

এখান থেকেই কবি সম্ভবত পান ঈশ্বরের ধারনা, যে ঈশ্বর ধুলোবালিময় পথে হাঁটতে বেরোন –
 “আমি ও ঈশ্বর জামা বদলাই
জীবন বদলাবার মতো,
স্নান সেরে
নিজেদের উদোম দেখে চমকে উঠি ।”

কবির  বোধহয় এটাই উপলব্ধি হয়, যে কোনও অজুহাতে অস্বীকার করার চেয়ে বিশ্বাসই বোধহয় উত্তীর্ণ করে মানবাত্মাকে
“তখন আর যুক্তি-টুক্তি কাজ করে না
শুধু
কোনো এক বোধ কাজ করে... ”

কবি ও ঈশ্বর খই ছড়িয়ে ফেরেন এবং লিখতে বসেন, শেষ পর্যন্ত কবি লিখে যান – কারণ সেটাই তার একমাত্র পরিত্রাণের
পথ – “ভাবি না, বিশেষ কিছুই আর ভাবি না,
লিখতে হয় লিখি । ”

যদিও কবির সংশয় ঘোচে না, নিজের ঢাক বাজানোর এই যুগে- দিনের পর দিন বছরের পর বছর ওয়েবজিনে কিংবা ছাপার অক্ষরে নিজের খরচে টিকে থাকার দুনিয়ায় আদৌ কি কোনও মূল্যায়ন হয় ! ভার্চুয়াল কিংবা নামী-আনামি সাহিত্যপত্র আর তাদের তৈরি করা গণ্ডায় গণ্ডায় কলমচির ভিড়ে কবিকে কখনো বলতে হয় - 
“কবি মানে কিছু অসুখী কথার মিছিল
অসুখী সবাই, তবু সকলেই কবি নয়”


কথাটা নতুন যদিও নয়, মহান কবিকে অনুসরণ করে লেখা ... তবু অনির্বাণের যে এই অপ্রিয় কথাটা লেখার সাহস আছে সেটাই বোধহয় আগামীর রসদ হয়ে উঠতে পারে । 

  সন্ত নিকোলাসের হাড়গোড়  / অনির্বাণ ভট্টাচার্য /  ধানসিড়ি ,  কলকাতা- ৭০০০৫০ 

যোগাযোগ  : ৮০১৭৪২১১৮৪




 

2 comments: