Tuesday, July 5, 2016

ঈশ্বরের থেকে গাঢ় / উজান


উজ্জ্বল অপিরিচিতের ডাক



সরোজ দরবার


এক একটা গানের সঙ্গে নানা স্মৃতির যোগ। এক অগ্রজের মুখের গল্প, পড়ার সময় রেডিও শোনার জন্য তাঁর বাবা সেটটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন, আর অমনি ‘...আমায় চমকে দাও, চমকে দাও।’ এই গানের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্তরে এই স্মৃতির অটুট সংযোগ। আবার ‘...সব যে হয়ে গেল কালো’- যখন যেখানে কানে আসুক, ভেসে ওঠে মেঘে ঢাকা তারা-র সেই বলিদান সদৃশ সুপ্রিয়া দেবীর মুখের ক্লোজ শট। এ সংযোগ একজনের জন্য নয়, বহুর। এর সঙ্গে আবার স্বতন্ত্র স্মৃতিরও যোগ থাকতেই পারে। এভাবেই যোগে যোগ বাড়ে। মুজতবা আলীর শান্তিনিকেতনের লেখা পড়তে পড়তে অবধারিত মনে পড়ে যায় প্রমথনাথ বিশি-র গুরুদেব প্রসঙ্গ। এক একটা গানে, লেখায়, বলা ভাল, এক একটি প্রসঙ্গের আয়তন এভাবে বেড়ে যায়। বয়স যত পরিণতির দিকে এগোয় এ আয়তন বাড়তে থাকে। মজা হল, আয়তন বাড়লেও এখানে অন্তত ঘনত্ব কমে না। এ একরমের বিপরীতমুখী রসায়ন। যত আয়তন বাড়ে অনুভূতির গাঢ়তা তত বাড়তে থাকে। এই এত্ত কথার আয়তন বাড়ল ওই ‘গাঢ়’ শব্দের প্রসঙ্গেই। হাতে ধরা কবিতার বইয়ের নাম যখন ‘ঈশ্বরের থেকে গাঢ়’।

দু’ফর্মার ছোট্ট বই। কবির হাজারো সাহসী কারিকুরীর চিহ্ন বুকে নিয়ে আছে। সেটাই স্বাভাবিক। ব্লার্বেও সে ইঙ্গিত। তরুণের ভাষার উচ্ছাসেই আগামিদিনের গতিপথ নির্মাণ। যে কোনও নতুন বই পড়াই একরকম অপরিচিতের ডাক। কখনও সখনও সে ডাক উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এই উজ্জ্বল অপরিচিতের ডাক- শব্দবন্ধটি আমায় শিখিয়ে দিল উজানের প্রথম কবিতার বই। ‘সন্ধ্যেতারা’ সিরিজের তিন নম্বর কবিতায় সে বলে,

‘ভিতর থেকে আমি প্রায় সারাদিনই গম্ভীর হয়ে থাকি। কেননা আমি রোজ ওই কথাগুলির কাছে যাই, থাকি। উজ্জ্বল অপরিচিত কথা আমাকে ডাকে...অসময়ে, অপরিচিতের মতো।’

এ কবিতা শুরু হয়েছিল গল্পচ্ছলে, সংকেতময়তায়-‘তোমার এক বান্ধবী তোমার টিয়ার কথা বলে।’, শেষমেশ পৌঁছল কবিতার দুনিয়ার এক সত্যিতে। তা এই উজ্জ্বল অপিরিচিতের ডাক, এবং সে ডাক আসে অপরিচিতের মতোই। আকস্মিক। মনে পড়ে, কবিতাকে ‘আকস্মিকের খেলা’ বলেছিলেন এক কবি, এবং এ নামে একটি কবিতা নিয়ে গদ্যের বইও আছে। এখন প্রশ্ন হল, আমি কি এই পংক্তিমালায় ঠিক বুঝতে পারছি কবিকে? উত্তরে পৌঁছনোর আগে বলে নেওয়া ভাল, কবিতার আলোচনার মতো মস্ত ব্যর্থতার পাহাড় টপকানো আমার অসাধ্য। আমার চেষ্টা, এই পংক্তিরা আমার কাছে কীভাবে ধরা দিচ্ছে তা তুলে ধরা। এই ‘সন্ধ্যেতারা’ সিরিজটার কাছে অনেকক্ষণ থাকতে ইচ্ছে করে, প্রেমের মৃদু অথচ গভীর আলো এর চারপাশ আলো করে আছে বলে অনুভব করতে পারি। কী বলে উঠতে চায় সিরিজের প্রথম কবিতার এই পঙক্তিগুলি-

   ‘তুমি আছ’ আর ‘তুমি নেই’ এর মাঝে যে পথ চলে যাচ্ছে
খুব দ্রুত, যে পথ ভরে ওঠা বা ফুরিয়ে যাওয়া...কিছুরই কথা বলে না,
ওই পথ আমি।

এ এক দারুণ ঝুনো প্রেমের অভিব্যক্তি বলেই আমার মনে হয়। কার সঙ্গে সেই ভালবাসা? মনে পড়ে, এক অনুষ্ঠানে সুমনের ‘তোমাকে চাই’ নিয়ে এক শিল্পী তাঁর অনুভবের কথা জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এই তুমি কে তা নিয়ে তাঁদের বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে অনেক তর্ক হয়েছে এবং শেষমেশ উপলব্ধি, এই তুমি আসলে সংগীত। উপরের লাইনের ‘তুমি’ও তাই তার ব্যক্তিসত্তা ছাপিয়ে আমার কাছে ধরা দিচ্ছে কবিতা হয়েই। এই যে পথের কথা বলছেন কবি, এর সঙ্গে কমবেশি দেখা হয়ে যাওয়া সৌভাগ্য। কবিতা আপনাতে পূর্ণ। কবি শুধু ওই পথটুকু, কখনও যার সঙ্গে কবিতার দেখা হয়, কখনও হয় না। যুগলমিলন হলে আমরা উলু দিই, কবিতার ইতিহাস বাড়ে। আর যতক্ষণ তা না হচ্ছে, ততক্ষণ মাথুর-অপেক্ষা। দেখি কবিও বলছেন-

ঘর সাদা করে বোঝানো হয় না অপেক্ষার চেয়ে সাদা আর কিছু নেই,
অপেক্ষাভাঙা চুম্বনের চেয়ে বড় পুজো হয় না যেমন  
       
এই বোধহয় সেই পুজো, যে কারণে কাব্য আসলে কবির অনুভবে ‘নৈবেদ্য’। এ কবি, তাঁর তারুণ্যের সাহসে হোক বা ‘দৈব’বশত প্রেমিক, উন্মাদ ও নাস্তিককে এমন একাসনে বসিয়েছে, যার কোনও আগুপিছু থাকা অসম্ভব। তাহলে পড়ে থাকল কী? শুধুমাত্র অনুভব থেকে অনুভবে পেরিয়ে যাওয়া। কবি তাই বলবেনই-
কেবলমাত্র পেরিয়ে যাওয়ার মধ্যে যে অনন্ত টান আছে
তারই প্রতিভায় আমি তোমাকে পেয়েছি-

বিচ্ছেদের চেয়েও বিস্তৃত এক মাঠে,
নতজানুর চেয়েও সমর্পিত এক পূজায়। 

এই পুজো সেই কাঙ্ক্ষিত অনুভবটুকুর জন্য, যা ‘ঈশ্বরের থেকে গাঢ়’। উজানের যাত্রা সেই অভিমুখে। আরও অনেকের মতোই। কিন্তু ইতিমধ্যেই সে পাতার কাছে রেখে এসেছে ‘প্রেমের অধিক জল’। তাঁর আগামী বইয়ের পাতাতে সে জল উচ্ছ্বাসের কলধ্বনি পেরিয়ে শান্ত, থিতু টলটলে দিঘির মতো হয়ে দেখা দেবে এমনটাই আশা।

আরও আশা এই যে, আপাত থিতু যে দিঘির চারপাশে আমাদের বাস, তার আশেপাশের নুড়ি, পাথর, সাপের ব্যাং গিলে ফেলাও নজর এড়াবে না কবির। যদি তরুণের ভাষা আগামিদিনের গতিপথ নির্মাণ করবে বলে এই আকালেও কেউ ভরসা রাখতে পারেন, তবে তরুণও ব্যারিকেড ভেঙে নতুন রাস্তা তৈরির পথ আবিষ্কার যেন না ভুলে যান। ঘুম থেকে ঘুম টপকে যেতে যেতে সন্ধ্যেতারাটিকে দেখা যতখানি জরুরি, ততোখানিই প্রয়োজন বলে মনে হয় তারার তিমিরটুকু উপলব্ধি করাও। ‘আমার সোনার বাংলা’র মায়াকাজল ভালবেসেও আমাদের নাগরিক কবিয়াল চিৎকার করে বলেছিলেন, শুধু আম, কাঁঠাল, কোথায় তোমার মানুষ কোথায়! আমার আশা, আগামীতে কেন্দ্রের উল্টোমুখে যাত্রা হোক উজানের। তাঁর খোঁজে ঢুকে পড়ুক মানুষ। আজ যদি তাঁকে কেউ প্রশ্ন করেন  - ‘একজন শ্রমিক/ হায় কি দুর্বল তার ইউনিয়ন /রেললাইনের দিকে তাকিয়ে ভাবছে /আত্মহত্যা করলে কি বাঁচা যাবে?// অনেকগুলো বাচ্চা/ পোস্টারের কাগজ আর প্যাকিংবাক্সের ঘরে/ খেলে খেলে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছে/ ওদের মা ফিরলে তবে খেতে দেবে।// এখন কি আমার শিল্পচর্চা করা মানায়?’’ ( নবারুণ ভট্টাচার্য)- তাঁর কবিতা যেন এ প্রশ্নেরও সমাধান ও ফলাফল খুঁজে দেয়। অন্তত চেষ্টা তো করতেই পারে।  অভিমুখ বদলে গেলে তাঁরই –ঈশ্বর হয়ে ওঠা তোমার অভ্যেস-এর মতো পংক্তি যে কী মারাত্মক সমসাময়িক, অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে তা অনুমান করেই অনেক কিছু আশা করতে ইচ্ছে হয়।      
    
আশা সেখানেই যেখানে অনুভবের গাঢ়তা আছে। এবং ভরসা, উজান নিরাশ করবেন না।
বইয়ের প্রচ্ছদ, ছাপা, বাঁধাই ইত্যাদি যথাযথ। এই অপিরিচিতের উজ্জ্বল ডাক পাঠকের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ প্রকাশককে। 

ঈশ্বরের থেকে গাঢ় /  উজানযাপনচিত্র

No comments:

Post a Comment