বাংলাদেশের বর্তমান ছোটগল্প : একটি ধারাবাহিক আলোচনা
(১ম কিস্তি )
পাতাউর জামান
দশক ওয়ারি লেখক ও কিছু বই পরিচিতিকরণ
দেশ বিভাজনের
আগে থেকেই বাংলাদেশে একটি ছোটগল্পের ধারা গড়ে উঠেছিল। মনসুরউদ্দিন, বন্দে আলি মিঞা, আবুল ফজল, শওকত
ওসমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ প্রমুখরা
স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশের ছোটগল্পের ধারা
শুরু করে দেয়। পঞ্চাশের দশকে সরদার জয়েনউদ্দিন, মিরজা আবদুল হাই, আবু ইসাক, সৈয়দ
সামসুল হক প্রমুখদের নাম আসে। এই দশকের গল্পকাররা মূলত গ্রাম বাংলার একমুখি জীবন-কলার কথা বলে। ষাটের
দশকে নাজমুল আলন, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, রিজিয়া রহমান, মাহাবুব তালুকদার, আখতারুজ্জামান
ইলিয়াস, আহমেদ ছফা, সেলিনা হোসেন প্রমুখদের নাম আসে। এই দশকে উপনিবেশিক শাসন সংকট
প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। সত্তরে হেলেনা খান, আল মামুদ, আবুবক্কর সিদ্দিক, হুমায়ূন
আহমেদ, শহিদুল জহীর, মঞ্জু সরকার প্রমুখরা প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। এই দশককে মুক্তির
দশক হিসেবেও দেখা হয়। আশি নব্বই দশকে কায়েস আহমেদ, হাসান আজিজুল হক, আলাউদ্দিন আল
আজাদ, সুশান্ত মজুমদার, হরিপদ দত্ত, মঈনুল আহসান সাবের, শাহাদুজ্জামান, মামুন হুসাইন,
মাসুদুল হক, মনিরা কায়েস, অদিতি ফাল্গুনী,
নাসরীন জাহান, জাকির তালুকদার প্রমুখ গল্পকারদের আবির্ভাব ঘটে। এঁরা বিষয় ও
প্রকরণ বৈচিত্রের সন্ধান দেয়। স্বাধীনতার প্রসঙ্গ ঐতিহ্য হিসেবে এঁদের গল্পে
এসেছিল। সেই সঙ্গে আসল আধুনিকতার ধ্বজা, যাতে মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে থাকে।
শাহাদুজ্জামান ‘কয়েকটি বিহ্বল গল্প’ বইয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্যকে, বিশেষত
ছোটগল্পকে উল্লেখযোগ্য স্থান নিয়েছে। শাহাদুজ্জামানের গল্প বলার মধ্যে একটা
অভিনবত্ব আছে। ভাষা ব্যবহারের স্বকীয়তা আছে। মানুষ অবস্থান করে একটি আশ্চর্য
বৈপরীত্যের জগতে- তাকে তুলে ধরেছেন। তুলে ধরেছেনসময় ও সমাজের পরিস্থিতিকে।
লোকগাথার গল্প বয়ানের সাথে আধুনিক গল্প বিশ্বের আঙ্গিককে ঢুকিছেন তার গল্পে। যেমন তাঁর
‘ইব্রাহিম বক্সের সার্কাস’ গল্পটি। মোট ২০ টি
অধ্যায়। এটি ‘পশ্চিমের মেঘে সোনার
সিংহ গল্প’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া(মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৯৯) বা‘কয়েকটি বিহ্বল গল্প’ বই এর প্রথম গল্প‘এক কাঠাল পাতা আর
ঢেলার গল্প’এর উপস্থাপন ও
নির্মাণ ভঙ্গি আশ্চর্য করে দেবার মত।
মামুন হুসাইন
মনোরোগ বিভাগে ছাত্র পড়ান রাজশাহিতে। ‘নিক্রপলিস’ উপন্যাসের জন্য ২০১১ তে বাংলার পাঠশালা, আখতারুজ্জামান
ইলিয়াস পুরস্কার পান। গল্পের বই ‘শান্ত সন্ত্রাসের চাঁদমারি’, ‘মানুষের মৃত্যু হলে’, ‘কয়েকজন সামান্য মানুষ’ ইত্যাদি। ‘অন্ধজনের জাতকথা’ ২০১৪ তে প্রকৃতি
থেকে বের হয় । তাঁর গল্প সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলা যায় তার গল্পে রঙ্গ তামাসার
সুযোগ, রগড় করার সুযোগ সর্বত্র। সমাজের জনপদের সময়কে অসাধারণ মনীষা ও বিক্ষা দিয়ে
বিচার করার ক্ষমতা লক্ষণীয়। অদেখা অজানা
সমজের জগতকে তিনি পাঠকের সাথে পরিচয় করি দেন। তাঁর ‘অন্ধজনে দেহো আলো’ গল্পটি অন্ধ মানুষের বিচিত্র আখ্যানকে তুলে ধরেছে। সেটা
আসলে পরিসরের খেলা। এখানে চরিত্র নেই।
বক্তা আমি। আখড়ায় এক দিকে গান হয়, একদিকে ক্যাসেট
বাজে। এটাই আসলে বাস্তব। এই বাস্তব ঐতিহ্য ও আধুনিকতার খেলা আছে তাঁর
গল্পে।
মাসুদুল হকের
১৬টির বেশি ছোটগল্পের বই। তিনি মূলত নব্বইয়ের গল্পকার। ‘তামাকবাড়ি’ তার সবথেকে আলোচিত গ্রন্থ। উত্তরবাংলার প্রান্তভূমিসংলগ্ন মানুষের
সামগ্রীক জীবন বোধ, অবহেলিত মানুষের লোকবিশ্বাস, জীবন ধারা সংস্কৃতির অনুষঙ্গ তার
গল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ‘ঢুকলিগাঁথা’ জীবনকে সহসাই তুলে আনেন রক্তমাংসের শরীরে। প্রতিবেশের
ঘুণ ধরা জীবনকে উপেক্ষা করার আশ্রয় শেকড়ে, কাটাতার সংলগ্ন জীবিনের সংগ্রামে।
একদিকে ধ্বংস অন্য দিকে নব-নির্মাণ এই নিয়ে তার গল্প এগিয়ে চলে। ‘নাবিকের জুতো’ ২০১৪তে শুদ্ধশর থেকে
বের হয় । নাবিকের জুতো, ধ্বংসস্তূপ , মুখোশ, চিনেজোঁক, চারটি গল্প, সে,
পুরাণের কথা এই ইত্যাদি গল্প গুলোতিনে এক দিকে ঐতিহ্যের ধ্বংস ও আধুনিকতার আশ্রয়
লক্ষণীয়।
মনিরা কায়েস এর
ছোটগল্প ‘মাটিপুরাণ পালা’, ‘জডাঙ্গার বায়োস্কোপ’, ‘ধুলোমাটির জন্মসূত্র’, ‘কথ্যমানুষপুরাণ’ এই গুলো
গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাঁর ‘ঐ যে স্ট্রেচার আসছে’ (২০১০, কথাপ্রকাশ)
বইটি খুব চমৎকার। একরৈখিক পাঠ নয়, সার্থক বহুরৈখিক আখ্যান নির্মাণেই তাঁর কৃতিত্ব।
সেখানে সেই ছবিটি যে ভাবে আমাদের হল, প্রিয় রাড়িখাল, স্মৃতিময় পালকের দিন,
চন্দনেশবরের মাচানতলায়, আমার জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী পাঠ, কায়েসের নকশালী গল্পেরা,
আমাদের শিশুসাহিত্য, ঐ যে স্ট্রেচার আসছে, যঞ্জিডুমুরের খোঁজে – এই আখ্যান গুলো
ছোটগল্পের স্বাদ দেয়। নকশাল আন্দোলন ও সে সম্পর্কিত রচিত আখ্যানকে যে ভাবে
সাজিয়েছে তা ছোটগল্পের স্বাদ দেয়।
অদিতি ফাল্গুনীর‘ইমানুয়েলের
গৃহপ্রবেশ’-এটি প্রথম গল্প গ্রন্থ। ‘অপৌরুষের ৭১’ এই বইটার জন্য বর্ষ
সেরা পুরস্কার পেয়েছিলেন। নক্ষত্র, শাপলা, স্পাটাকাস ও ভাসান যাত্রার গল্প
গুলোর বিষয় ও আঙ্গিকের দিক দিয়ে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
নাসরীন জাহানের পাঁচটি গল্পের বই। মূলত ‘উড়ুক্ক’ উপন্যাসের জন্য তিনি
খুব বিখ্যাত হয়েছেন। ‘স্থবির যৌবন’ তার প্রথম বই। ‘বিচূর্ণ ছায়া’ ১৯৮৫ সালে বের হয়
২১শের বই মেলায়। ‘কাঠপেঁচা’, ‘পাখি তুমি সেই দিন রাতে কাঁদছিলে কেন’, ‘সম্ভ্রম যখন অশ্লীল
হয়ে ওঠে’ (১৯৯৭ ; অন্যপ্রকাশ)
গল্পের বেলায় একদিকে ধ্রুপদী কথাবস্তু নির্মাণ, আবার কখন নেরেটিভ বা
এন্টি-নেরেটিভের দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়ে নিজেকে বিশ্ব
মানের লেখিকায় উত্তীর্ণ করেছেন। ‘বিচূর্ণ ছায়া’ গল্পের বইএ ‘সুন্দর
লাশ’ গল্পটি নির্মাণের দিক দিয়ে দারুণ।
মনলগের ভঙ্গিতে জিনাতের সাথে উপস্থাপন নয়, যে ভাবে ৮ টি শিরোনামে বিন্যস্ত করেছেন,
ন্যারেটোলজির আধুনিক প্যাটানকে সৃষ্টি করেছেন, তা চমৎকার। বা ‘অভ্যাসের গফুর আলি
বা রজ্জু’ গল্পের কথাটিও স্বীকার করতে হয়।
‘সম্ভ্রম যখন অশ্লীল
হয়ে ওঠে’ এই বইএ ‘পূর্বপুরুষ’
আর ‘সোনার মাকড়োসার গল্প’– এই গল্পটিতে গল্পের কাহিনি নয় সিচুয়েশন তৈরি বড়ো হয়ে
দাঁড়ায়।
জাকির তালুকদার
৯০ এর একজন অন্যতম গল্পকার। বিষয় সচেতনতা ও আঙ্গিক সচেতনতা। “অথচ নিজের নামের
সঙ্গে নিরীক্ষামূলক গল্পকারের তকমা আমি নিজে কোনো দিন কামনা করি নি। কারণ ‘আঙ্গিকবাদীদের
চিৎকারকে’ আমার কাছে সব সময়
গৌণ লেখক বলে মনে হয়েছে। … আমি নিজে বিশ্বাস করি ‘সঠিক বিষয়ের জন্য সঠিক আঙ্গিক’ তত্ত্বে”। ‘স্বপ্নযাত্রা কিংবা
উদ্বাস্তুপুরাণ’ (১৯৮৮) তাঁর প্রথম
গল্পের বই। ‘বিশ্বাসের আগুন’, ‘কন্য ও জলকন্যা’, ‘কল্পনা চাকমা ও রাজার
সেপাই’, ‘হা-ভাতভূমি’, ‘মাতৃহত্যা অন্যান্য গল্প’- তার এই সমস্তগল্প গ্রন্থের গল্প সম্পর্কে বলতে গিয়ে
লেখা হয়েছে –‘অবাস্তব
কলাকৈবল্যবাদ এবং অগভীর বাস্তববাদ’ -এই দুই রুগ্ন প্রবনতার হাত থেকে মুক্ত জাকির তালুকদারের রচনা। বাংলা গল্পে মুসলিম মিথ প্রয়োগে প্রথম ও
সফল পথিকৃৎ তিনি। আবার বাংলাদেশের নিম্নবর্গের মানুষ নিজেদের বেঁচে থাকার তাৎপর্য
সংগ্রহ করে যে উৎস থেকে, সেই ‘গ্রামীণ সামাজিক আধ্যাত্মিকতা’র প্রথম আবিষ্কার এবং প্রয়োগ জাকির তালুকদারের গল্পেই’। ইতিহ্য ও সমাজ পাঠের আসর তার ‘কন্য ও জলকন্যা’ বই এর মুল কথা। ‘সোলেমান পয়গম্বরের দেয়াল’ এ মুসলিম মিথ, ‘মকবুল মাস্টারের জীবন যাত্রা’ গল্পে সাধারণ বাংলাদেশের স্বর, ‘পিতৃপরিচয়’ গল্পে মেরুদণ্ড
সোজা বাংলাদেশের মানুষ-কথা বর্ণীত। ‘পিতৃগণ’ উপন্যাস কৈবর্তদের
জীবন ইতিহাস, কাহিনি নয়(সত্যেন সেন
বিদ্রোহী কৈবর্ত’ )। ‘মুসলমানমঙ্গল’ মুসলিম মিথ ও ডকুমেন্টেশনের কাজ করেছে। আনেকটা
ডকুফিকশনের মত। ফিকশনাইড হিসট্রি নয়। ‘কুরসিনামাতে’ প্যারালাল ন্যারেটোলজি তৈরি করেছেন। উপন্যাসটিতে দুটো
আখ্যান সমান্তরাল ভাবে এগিয়েছে। কবি আব্দুস সুকুরের গুপিচন্দ্রের সন্ন্যাস পুঁথির
প্যারালালি কথক ফকির আলি এর সাথে চলছে নায়কের জীবনানুসদ্ধান। আজার নাফিসি ‘রিডিং লোলিতা ইন
তেহেরা’ নভেলে এমনটা
করেছিলেন। সেখানেও আখ্যানের মধ্যে আখ্যান তৈরি হয়েছিল। তেহেরানের পরিস্থিতিতে নারী
সমাজ জীবন এবং লোতিতা পাঠ সমান্তরাল ভাবে এগিয়েছিল।
শাহিন আখতারের
‘শ্রীমতির জীবন দর্শন’ প্রথম গল্পের বই। ‘বোনের সংগে আমর লোক’, ‘আমারও প্রেম আছে’, ‘শিস ও অন্যান্য গল্প’ বিষয় বৈচিত্রে দারুণ। ‘ময়ূর সিংহাসনন’ আসলে মুঘল সুলতান ও আরাকানের ডকুমেনটেশন নিয়ে ডকুফিকশন
তৈরি করেছেন। ‘তালাস’, বা ‘সখীরঙ্গমালা’তে রঙ্গমালার কাটা
মুন্ডু ও সামশের গাজির কথা এর সাথে লোক
বাতাবরণ এবং গল্পের কথন ভঙ্গি নান্দনিক মনে ধরবার মত। ‘শিস’ গল্পতে আমিরণের
হেজিমনি ও নারী মানসিক্তা প্রধান। ‘পাঁচটা কাকা ও একজন মুক্তি যোদ্ধা’ গল্পটিও
চমৎকার।
যেটা দিয়ে শুরু
করব ভেবেছিলাম
প্রথমেই এটা স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে গল্প পড়া আর গল্প
পড়ে সে গল্পের সমালোচনা করা দুটো ভিন্ন জিনিস। সুতারং এটা স্বীকার করে নিয়ে কথাবাত্রা
এগোনোই ভালো। তাতে বুক রিভিউ পড়া পাঠকের এবং লেখকের সুবিধে হয়( যদি লেখক পড়েন)। বই
নিয়ে আলোচনা বা বই নিয়ে সমালোচনা এই দুটোই
অর্থ লুকিয়ে আছে বুক রিভিউ শব্দের মধ্যে।
বাংলায় বুক রিভিউ এর দু ধরনের ধারা আছে মানতে হয়, তার
মধ্যে একটা হচ্ছে পণ্ডিতি ধারা। স্কুল কলেকের পাঠ্য বই, সেমিনার ইত্যাদির জন্য
বহুল ভাবে আলো চিত হতে পারে। আর একটা হল মনন ধর্মীতা, টেক্সটূয়াল আলোচনা। এখানে এই
বই এর এত গুলো চরিত্র আছে। এই বই, এই গল্প, এই নায়ক চরিত্র এই ভাবে বিবর্তন হয়েছে।
এই ভাবে রচনাতে সামাজিক রাজনৈতিক ইত্যাদি বিষয়কে তুলে ধরেন। নাম করণের সার্থকতা
বিচার করেন। সে পথে হাঁটতেইপারি কিন্তু ইচ্ছে করে এড়িয়ে চলব আমরা। কারণ একটাই বই
গুলো থেকে আমরা একটা আখ্যান খুঁজব। খুঁজে দেখব সেই আখ্যান গুলোতে কী ভাবে সমস্তটা
ধরা পড়ে আছে আর কেনো রচনাকার এমন আখ্যান বুনন করেছে। আসলে সংলাপ থামতে পারে,
কিন্তু তর্ক থামে না। কেউ তর্ক করে বলতে পারেন, ‘ তর্ক থামে, সংলাপ থামে না’। কারণ
আমাদের অধোগঠনে অনবরত অথচ অনুচ্চারিত ভাবে সংলাপ তৈরি হচ্ছে। সুতারং বিতর্ক জিইয়ে
রেখে আমাদের চলা।
বই নিয়ে আলোচনা করার একটা বড়ো সমস্যা হচ্ছে ঠিক ভূলের
মান্যতায় বইকে বেঁধে দেওয়া। এই ঠিক ভুলের মাত্রা তৈরি করার নৈয়ায়িক নন সমালোচক বা
আলোচক। আসলে দার্শনিক তর্কে প্রত্যেক ঠিকের যেমন একটি ভুল থাকে তেমনি প্রত্যেক
ভুলেরও একটি ঠিক থাকে। সুতারং ঠিক ভুল, বলতেই পারেন বই এর ক্ষেত্রে , কদানচ। এছাড়াও
এটিও সত্য যে লেখক যাই লিখুক তিনি তো তাঁর নিজস্ব একটা বিশ্বাস থেকে লেখেন। বরং
আসুন আমরা দেখি লেখক যে অখ্যান তৈরি করেছেন আর স্বরূপ বোঝবার চেষ্টা করি। চেষ্টা
করি লেখক সংরূপ মানছেন না সংরূপ ভাঙছেন। না কি এমন একটা আখ্যান তৈরি করছেন, যার
মধ্যে নিজেকে ভাঙছেন অথবা গড়ছেন অথবা নিজেকে খুঁজছেন অথবা নিজের জাপিত সময়ের অবয়ব
তৈরি করছেন ইত্যাদি এরকম কিছু বিষয়।
কিস্তি ১ : যে গুলো পড়েছি, তার মধ্যে কয়েক জন
অদিতি ফাল্গুনীর ‘বানিয়ালুকা ও অন্যান্য গল্প’ লেখিকার দ্বিতীয় গল্প গ্রন্থ।
লেখিকার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ ইমানুয়েলের গৃহপ্রবেশ’ ১৯৯৯ সাল নাগাদ বের হয়। দ্বিতীয়
গল্পগ্রন্থটি বের হয় ২০০৫ সালে, ঐতিহ্য ঢাকা থেকে। ওঁর প্রথম ও দ্বিতীয়
গল্পগ্রন্থের মধ্যে প্রকরণ ও সজ্জাগত দিক থেকে দুটো মিল খুঁজে পাওয়া যায়। প্রথম ও
দ্বিতীয় বই এর ক্ষেত্রে গল্পেরই সংখ্যা সাতটি করে। এবং সাতটি গল্পের আখ্যান বৈচিত্র
চোখে পড়ার মতন। বানিয়ালুকা, হেরুকের বীণা, সৌভাগ্যের রজনী, আক্কাস নিবাড়ন কন্যা
মর্নিং ডিউ লিপজেল মিস বাংলাদেশ, ‘‘জাফর, চিনিজাতক, জয়নালউদ্দিনস্ ট্র্যাভেলস্,
আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা, ব্রিংনি বিবাল – এই সমস্ত গল্প গুলো। গল্প গ্রন্থের
জ্যাকেটে এই সাতটি গল্পের সম্পর্কে লেখা আছে ‘ বসনিয়া হার্জেগোভিনায় জাতিসংঘ
শান্তিরক্ষা মিশনের দায়িত্বে কর্মরত বাঙালি ও বাংলাদেশি বৈমানিক সৌবীর আহমেদের
চোখে সার্ব-বসনীয়-ক্রোয়াট জাতি সমস্যার নানা দিক তার প্রথম গল্প ‘বানিয়ালুকা’-য়
যেমন উন্মেচিত,দ্বিতীয় গল্প ‘হেরুকের বীণা’র প্রেক্ষাপট চর্যাপদের কালের বংলাদেশ।
শবেবারাতের রাতে বাংলাদেশের পতিতা মেয়েদের প্রার্থনা-ইবাদত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের
সময় গোড়া সৈন্যদের হাতে ধর্ষিতা গ্রাম্য নারীর দৌহিত্রির গর্ভে এক সুদখোর বামন
কীভাবে জন্ম দেয় অপরূপ সুন্দরী তরুণীর যে কালে কালে হয় মিস্ বাংলাদেশ, স্বৈরাচারী
এরশাদ সরকারের বানিজ্যমন্ত্রী কাজী জাফরের চিলি কেলেঙ্কারি কিভাবে ভূলিয়েছে
স্বল্পআয়ের মানুষকে অথবা এক উন্মূল সিলেটি রিক্সাআলাও জবানবন্দি, বৃহত্তর
উত্তরবাংলা ও চা বাগানের সাঁতাল , খাশিয়া গারোদের সাথেমধ্যবিত্ত শহুরে গবেষকদের
মিথস্ক্রিয়াও গ্রন্থিত হয়েছে এ গল্পগ্রন্থে।
শুধু বিষয়বস্তুই নয়, বিষয়
অনুযায়ী প্রতিটি গল্পে বদলেছে অদিতির ভাষা রীতির ব্যবহার ও শব্দচয়ন। কোলাজও করেছেন
তিনি। পঞ্চম গল্প ‘ জাফর, চিনিজাতক’ এ ১৯৮৫ সালে সংবাদপত্রের চিনি কেলেঙ্কারি খবর
ও বৌদ্ধযুগে উৎকোচ বাঁ ঘুসগ্রহণকারী রাজ অমযত্যের গল্প ‘ কিংছন্দোজাতক’ মিলিয়ে
দিয়েছেন তিনি। ষষ্ঠ গল্প ‘জয়নালউদ্দিনস্ ট্র্যাভেলাসে্’ও সিলেটি রিক্সাওয়ালার
আত্মকথনের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে ‘ গালিভারস্ ট্র্যাভেলাস্’ এর নির্বাচিত কিছু
অংশ। ‘সৌভগ্যের রজনী’ গল্পে ইসলামী হাদিস ব্যবহৃত হয়েছে আবার সাঁওতালি
সৃষ্টিতত্ত্বের পুরাণ এসেছে ‘আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা’য়’’।
এই সাতটি গল্পের মধ্যে ‘বানিয়ালুকা’
আর ‘আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা’ এই দুটি গল্প এখানে গুরুত্ব পাবে। কারণ এই নয় যে অন্য
গল্প গুলি গৌণ। অন্য সব গল্প গুলো বিষয় বৈচিত্র ও গল্প বয়ন শৈলীতে প্রশংসা পাওয়ার
যোগ্য। বানিয়ালুকা গল্পের আখ্যানের বিচার যদি করি তাহলে এর আখ্যানের অংশ সামান্য। বসনিয়ার
বানিয়ালুকা শহরেজাতিসংঘের শান্তি রক্ষার জন্য পোলিশ, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি দেশ থেকে
যেমন বায়ুসেনা পাঠানো হয়েছিল বাংলাদেশ থেকে তেমনি গেছিল সৌবীর। ওখানে শিনিসার
বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল শিনিসার বৌ লুকার সাথে। লুকা মুসলিম মেয়ে।
শিনিসা ওকে বিয়ে করে। পরবর্তী কালে শিনিসা তার স্ত্রীর এই এই ধর্মীয় পরিচয়কে
লুকোয়। সৌবীর নিজের পরিচয় লুকোয়, সে যে একজন মুসলিমসেটা সে লুকাকে কাকে জানায়। রাদোভানের
হাত দিয়ে সে যে চিঠি পাঠায় তার বিষয় এখানে না থাকলেও লুকা প্রত্যুতরে যে চিঠি
পাঠিয়েছিল যেখানে লুকার কথা থেকে জানা যায় যে লুকাকেই শুধু তার প্রকৃত পরিচয় জানায়
ও তার দেশে নিয়ে আসার কথা ভাবে। গল্পের শেষে এটা স্পষ্ট হয় যে লুকার প্রতি তার যে
অনুভূতি সহানুভূতি জন্মেছি, তার অপর নাম প্রেমের অনুরাগ। যখন দেখি শারমিন ও
সৌবীরের মেয়ের নাম লুকা। এটাই আসলে এ গল্পের মোটা দাগের আখ্যান যে আখ্যানকে আরো
পুষ্টি দেয় বসনিয়ার সার্ব, ইত্যালীলা, মুসলিম ও খ্রিস্টান এর বাহু আস্ফলনের
সমস্যা। এই ডকুমেন্টেশন উপস্থাপনে লেখিকা ‘ক’, ‘খ’ – এমন পয়েন্টের আধারে কোলাজ
করেছেন। কিন্তু এই ডকুমেনটেশনের আধারে অন্যান্য সমস্যার সাথে আছে আর একটি সমস্যা –
সংখ্যালঘু অস্তিত্বের সমস্যা। সৌবীর বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু হলেও বানিয়ালুকাতে
কিন্তু সংখ্যালঘু। ঠিক যে ভাবে শিনিসার স্ত্রী লুকা সংখ্যালঘু। সংখ্যালঘুরা
নিজেদের মধ্যে একটা সংঘবদ্ধতা তৈরি করে একদিকে যেমন দিজেদের বাচাতে, তেমনি নিজেদের
অস্তিত্ব ঘোষণা করতে। এখানে, এই গল্পে সৌবীর লুকার কাছে চেয়েছিল নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করতে আর লুকা
চেয়েছিল নিজের অস্তিত্ব বাঁচাতে। সে কারণে লুকা লিখেছিল,
‘প্রি আহমেদ,
আমি লুকা। প্রিস্টিনা থেকে
তোমাকে আমি এ চিঠি লিখছি।
তোমার চিঠিতে তুমি আমাকে
জানিয়েছ যে তুমি মুসলিম, যদিও প্রথাগত অর্থে ধর্ম তুমি পালন কর না। তুমি আরো
জানিয়েছ, কখনো খুব সংকটে থাকলে আমি তোমাকে চিঠি লিখতে পারি।
... বড়ো সংকট আমার, আহমেদ।
... সার্বরা বড়োসড় মাপের বীর,
তাই তারা প্রচুর সংখ্যক মুসলিম মেয়েকেই ধর্ষণ করেছে। ... কখনো বলকান ছেড়ে অন্য
দেশে যাওয়ার কথা ভাবিনি। আজ মনে হয়, পালিয়ে যাই অন্য কোনো দেশে।’
আর এখানেই এ গল্পের আখ্যান
সমৃদ্ধ। কিন্তু গল্পের মধ্যে যেভাবে সৌবীরের মাধ্যমে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি সফট
কর্নার দেখিয়েছেন, তাতে লেখিকার নিরপেক্ষতা হারিয়েছে বলে মনে হয়েছে। সৌবীরের
ছোটোমামা প্রসঙ্গে এসেছে বাংলাদেশের মৌলবাদী মানসিকতা ও মৌলবাদ সমস্যা। যা আজকের
বাংলাদেশের কাছে একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ।
অদিতি ফাল্গুনীর গল্প বলার ধরণ
অর্থাৎ যে ভাবে তিনি গল্পটাকে উপস্থাপিত করেন ও বলেন সেটা আকর্ষণীয়। তাঁর এই এই
সমস্ত গল্প পড়টে গিয়ে এটা মনে হয়েছে গল্পের মধ্যে তিনি ঢকুমেনটেশন দিতে পছন্দ করন এবং
থাকে সেই ঢকুমেনটেশন উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ডিটেলিং। ‘আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা’ গল্পেও
দেখি এই ডকুমেনটেশন ও কোলাজের কারিগরি। তাঁর গল্পে ধর্মীয় মিথের ব্যবহার বেশ
চমকপ্রদ। এই গল্পটা শুরু হয়েছে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের ‘পিলচু হড়ম’ আর ‘পিলচু বুহড়ি’র
সৃষ্টির মিথ দিয়ে। মারং বুরু, যিনি পিলচু হড়ম আর পিলচু বুহড়ি নামে প্রথম পুরুষ ও
নারী সৃষ্টি করেন। এখানে স্মরণ রাখতে হবে লেখিকার ক্রমিক বিবরণ নারী পুরুষ নয়,
পুরুষ নারী এই ধারা। আসলে বর্ণনা যে আলাদা হবে এটা হয়ত সেটার কথা স্মরণ করায়। তাদের
সাত ছেলে আর সাত মেয়ে হয়। সেখান থেকেই পৃথিবীর যাবতীয় মানুষের উৎপত্তি। গল্পটা
কোলাজের হলেও গল্পটার মূল ট্রিটমেন্ট লুকিয়ে আছে গল্পটার মধ্যে বাংলাদেশের আদিবাসী
বাঁ সংখ্যালঘু, এঁদেরকে কীভাবে দেখা হচ্ছে এবং কারা দেখছে এবং তাদের দৃষ্ট ভঙ্গি-
এর মধ্যে। এবং এটিকে বড়োগল্প প্রকরণের মধ্যে ফেলা যায়। কিন্তু বিষয়গত এক মুখিনতার
ফলে ছোটগল্পের মেজাজ যেমন রক্ষিত হয়েছে, তেমনি কখন কখন পাঠকে এক ঘেয়েমি বোধ হতে
পারে। কিন্তু সমাজ বিজ্ঞানের নিরিখে দেখলে দেখায়ায় এটাই এ গল্পের মূল সম্পদ। এবং
এও মনে হতে পারে কী ভাবে সমাজ থেকে তাত্ত্বিক কাঠামো উঠে আসে বাস্তবের। গল্পটা
শুরু হয় ‘দিনাজপুর, গাইবান্ধা, রাজশাহীর বরেন্দ্র, নাচোল, আমানূরা, যুগিডাঙ্গা,
তানোর, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জে কত শ’বিঘা জংলা জায়গা-জমি সাফা করে আবাদ
করেছি,পত্তনি করেছি, সেসব মা, আপনারা দিকু(হিন্দু) বাঁ মুসলমানরা। কি বুঝবেন?
দিকুরা একটা সময় কত অত্যাচার করেছে আমাদের – ইন্ডিয়ায় এখনো করে-আর এই দেশে এখন
অত্যাচার করে মুসলমানরা, আপনি কি মা সব লিখতে পারবেন?’ এই জন্য ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ‘গারো, চাকমা, ও সাঁওতাল শিশুদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক
শিক্ষার সম্ভাব্যতা যাচাই’র জন্য নাসরীন পর্ণা, হৃতিক চাকমা, আলফান্সো ম্রং আর
শাশ্বতী মন্ডল যাচ্ছে ময়মনসিংহ, সুসং, দুর্গাপুর, গারো অঞ্চলে। লাউলাতুন্নেছা
লায়লা, তানিশা রায়, নএশ , মুনতাসির যাচ্ছে উত্তর বাংলার সাঁওতাল এলাকায়। মনোয়ার
জামাল স্যারের নির্দেশ মত তানিয়া নোটবুকের পাতায় ‘ আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা’র জন্য
আশিটা প্রশ্ন ঠিক করে যার মধ্যে শিশু বড়ো, বৃদ্ধ, শিক্ষক, সরকারী কর্মচারী
প্রমুখদের জন্য আলাদা আলাদা করে নির্ধারিত তৈরি প্রশ্ন আছে। আসলে জীবনে ও স্মাজে
পিছিয়া পড়া এই সব আদিবাসী সংখ্যালঘুদের জীবন উচ্চবিত্তদের কাছে, সরকারের কাছে এটা
গবেষণার বিষয় মাত্র, যা খাতা কলমে লিপিবদ্ধ থাকে। প্রকৃত সমস্যার সমাধান হয় না। লেখিকা অদিতি ফাল্গুনীর কৃতিত্ব এখানে যে
তিনি ‘গোবিন্দগঞ্জের পথে : জোহর, প্রভু
যিশুর নামে সুস্বাগতম’, ‘লুথারান মিশনের পথে’, ‘ঘোঢ়াঘাট সর্গ’, ‘রংপুর সুগার মিল’,
‘তানিশার ফিল্ড নোট বুক থেকে উদ্ধৃতি’, ‘তানিশার ফিল্ড নোট থেকে’, ‘শ্রীহট্ট
আখ্যান : জমিন মাপি কিয়াড়ের মাপে হে’ – এই সব শিরোনাম
দিয়ে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সমাজের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক এমন কী ধর্মীয় সংকট প্রবল
ভাবে ফুটে ওঠে পাঠকের সামনে। সেখানে রোজালিন হাঁসদা ছ্যামুয়েল হেমব্রমবা রেভারেন্ড
সিপানিয়েল বা টিনা কিস্কু বা আরনেস্ট সারেন – প্রমুখদের সময় সমাজ ও জীবন হয়ে ওঠে
এই আখ্যানের মূলাধার এবং পাঠেকের লাভের অঙ্ক।
‘তানিশার ফিল্ড নোট বুক থেকে উদ্ধৃতি’ এবং ‘তানিশার ফিল্ড নোট থেকে’ – এখান
থেকে স্পষ্ট হয়েছে প্রভাবী সংস্কৃতি ও প্রতাপের দৃষ্টি ভঙ্গি, যা এই গল্পের সমাজ
বিশ্লেষণের একটি বড়ো দিক সূত্র।
যে সমস্ত পাঠক আকিমুন রহমানের ‘বিবি
থেকে বেগম’,‘আঠারো কাঠার বাড়ি’ ইত্যাদি বই গুলো পড়েছেন, তাঁদের কাছে যেমন আকিমুন
রহমান নতুন নয়, তেমনি তাঁর গল্পকার সত্ত্বাও হেলা ফেলার নয়। তেমনি আর একটি বলিষ্ঠ
আখ্যান ‘ রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি’ উপন্যাসটি। একটা বিষয় স্পষ্ট যে আকিমুন
রহমানের আখ্যানে নারী ও নারী মনন এবং সমাজ প্রতাপের স্রোতে ও বিপরীতে নারীদের
আবস্থান – এই বিষয় গুলো খুবই গুরুত্ব পেয়ে থাকে। সমালোচকরা বলেই থাকেন, এটাই নাকি
ওনার সিগনেচার। ওনার অন্য বই গুলো সম্পর্কে এ বিতর্ক থাকতে পারে কিন্তু রক্তপুঁজে গেঁথে
যাওয়া মাছি উপন্যাসে আখ্যান বিশ্লেষণে এ কথা অস্বীকার করা যায় না। উত্তম পুরুষের
জবানে, পারবিন, প্রাইমারী স্কুলের মাস্টার, যে তাঁর নারী জীবনের কথা এখানে বলেছে। কিন্তু এ বলা সে
বলা নয় যে পাঠক জোর করে পড়বে, বরং এই বইটি বর্তমানে যে ভাবে আনপুটডাউনেবেল আখ্যান
পাঠের রীতি তৈরি হচ্ছে – এই বইটি যেন পাঠকের কাছে সেই স্বাদ দেয়। পারবিনের চল্লিশ
বছরের ঘটনাকে পাঠক এক লহমায় জেনে যান, কিন্তু পারবিনের চল্লিশ বছরের প্রত্যেক
দিনের, সময়ের, ঘন্টার এমন কি মিনিটের কষ্টের ব্যাথার ঘুমরে বাঁচার সমস্ত অভিলাষকে
জেনে যায়।
গল্পটা শুরু হয় জিনেট কথিত
ইমপ্লায়েড রিডারের সাথে ইন্টার্যাকশানের
মাধ্যমে কিছু জানানোর মাধ্যমে:
‘এই যে আমি, আমি এক মেয়ে। আমার
বয়স চল্লিশ বছর। চল্লিশ বছর হলে মেয়েমানুষের জীবনের আর থাকে কী? আমার জীবনেও
সব শেষ। আশা শেষ। চাওয়া শেষ। পুরুষকে
পাওয়ার দিন শেষ। চামড়ার টান শেষ। সব শেষ। অথচ দেখো আমার জীবন সংসারে কোনো নুনের
স্বাদ পেল না।
...
আমি পেতে চেয়েছিলাম অন্য সকলের
মত জীবন-সংসার জীবন, বিয়ের জীবন, স্বামীর সঙ্গের জীবন। হল না হল না। আমার সবার মত
জীবন হল না। আমার জীবন হয়ে গেল অন্য সকলের চেয়ে ভিন্ন। অন্য রকম এক জীবন; ঘৃণায়
জবজবে, কান্নায় গ্যাদগ্যাদে আর লজ্জায় জড়ানো। এমন কি আমি চেয়েছিলাম? এমন কি কেউ চায়?’
-না চায় না। পারবিনের এই চাওয়ার
জীবন ও না চাওয়ার জীবন( যেটা চল্লিশ বছর বয়েসে এসে ভোগ করছে) – এই দুয়ের ঘটনা
পারম্পর্যে বর্ণিত আখ্যানের মধ্যে পারবিন আসলে বাংলাদেশের ফাস্ট জেনারেশন লারনার
পরিবারের ও নারী সমাজের প্রতিভূ হয়েছে। আসল নাম পারভীন হলেও সবার কাছে সে পারবিন।
সবাই ওকে সবার মত গড়ে ও ব্যবহার নিতে চেয়েছে। চেয়েছে জুম্মা কাক্কা, চেয়েছে দেলু
ভাই, চেয়েছে বুজি, ছেয়েছে পাগলা ভাই শাহআলম, চেয়েছে সুলতান আলি, এমন কি পারবিনের
নিজের আব্বা হোসেন আলিও।
পারবিন নিজের পরিচয় সে নিজেই
দিয়েছে, ‘ আমার নাম পারভীন আক্তার, কিন্তু সে নামে এখন আমাকে কে আর ডাকে! এখন আমার
নাম মাস্টারনি। সবাই আমাকে মাস্টারনি বলে ডাকে। আমি পাঠানতলি ফ্রি প্রাইমারি
স্কুলে মাস্টারি করি। যে বছর আমি ম্যাট্রিক পাস করি, ওই বছরেই আমার এই চাকরি জোটে’।
কিন্তু পারবিনের এই স্বীকারোক্তি তাঁর চল্লিশ বছর বয়েসে এসে। এই আখ্যানে পারবিন চরিত্রের বিশেষত্ব তার সঙ্গে হওয়া আবহেলায়, সমাজে
প্রতিষ্ঠা পেলেও অস্বীকৃতির কারণে এবং তার শরীরী যৌনতার কারণে। ক্রমস্য বড়ো হতে
হতে গায়ে ও পায়ে চাপে ফ্রকের সঙ্গে পায়জামা, বিশেষ নারী লক্ষ্মণ। আর নারী দের জণ্য
বর্ণিত রেহাল কাঠের কোরান শরীফ রেখে পড়া শেখা এবং সঙ্গে চলে পীরের হুকুমনাম
‘মেয়েদের লেখা পড়ায় কোরান শরিফে কোনো বাধা নেই’ মেনে মুর্শিদের আদেশ মানা পরিবারে
আসে নানা বিপর্যয়। কেবল মাত্র নারী পরিচয়ে বহন করার সুবাদে মাস্টারি হওয়া জন্য
রাস্তায় টোন টিটকারি শুনতে হয়। বিয়ের বাজারে পাত্র পাওয়া যায় না। আর এই সঙ্গে পারবিনের বয়সন্ধির যৌন মানসিকতা,
যেটাকে লেখিকা স্পষ্ট ও ডিটেলিংর সাথে পারবিনের জবান দিয়ে বের করেছে। এই রকম
বলিষ্ঠ ও বিশদ ভাবে প্রকাশ খুব কমই দুই পার বাংলায় হয়েছে। চলিত্র ও গল্পকারের এই
দিক পাঠকে আকর্ষিত করে। ‘ পুরুষ পুরুষ করে কেটে গেল পুয়ার যৌবন। এত দাগা দিল এত
পোড়া খেলাম তবু দেক্ষি দাগি মন পুরুশশষের জন্য কাঁদে। তবু দেখি তাপি শরীর পুরুষের
জন্যে হায় হায় করে।আমার শরীর পুরুষের গায়ের গন্ধের জন্যে কাঁদে’। গোটা উপন্যাসে
পারবিনের এই চাওয়াতে কেটেছে। একটা সময় মনে হতে পারে পারবিনের মধ্যে কোথাও একটা
স্খলন নয় বিকলন দেখা দিচ্ছে। কিশোরী বয়েসে রাহেলা বুবুর সাথে যে শরীরী খেলা তা
ক্রমস্য তাকে পুরুষের শরীরের প্রতি আকর্ষিত করে। জুম্মা কাক্কায় যখন প্রেমের নাম
করে শারীরিক সম্পর্ক করে, ‘পারবিন, আরে
পারবিন, তর জন্য এই দিলে আগুন জ্বলে। পারবিন, আসমান তেনে চান ছিইড়া, তর হাতে দুমু
আমি। দুনিয়াই কী না পারমু করতে, তর জন্য!
জুম্মা কাক্কায় এত কথা বলে কেন!...চুপ কথা থাক-চুপ থাক।
চুপ থাক দুনিয়া, চুপ থাক। এখন শুধু আমি আমার শরীরের কথা শুনব’। এই ঘটনার বারংবার
অনুবর্তনের পারবিনের বিশ্বাস হয়েছিল জুম্মা কাক্কায় তাকে বিয়ে করবে। জুম্মা
কাক্কায় তাকে বিয়ে করেনি। এরপর এসেছিল সুলতান আলি, বিয়ের আগে বিশ্বাস করে সুলতানের
সাথেও সম্পর্ক গড়িয়ে ছিল। কিন্তু সুলতান আলি পারবিঙ্কে বিয়ে করে নি ‘যেই মাইয়ারে
তু করতেই কাপড় খুইল্লা চিৎ হয় বিয়ার আগে – অরে আবার বিয়া করোন লাগেনি?’ পারবিনের
ট্র্যাজেডি তার সরল মনের বিশ্বাস। আর এই বিশ্বাসের কারণে বার বার ঠকেছে। বড়ো লোক
শাহাবুদ্দিনের মেয়েকে সুলতান বিয়ে করবে সংবাদ শুনে বুজির সাথে ব্যাথ ঝাড় ফুক পানি
পড়ায় টাকা খরজ করেছে। ততদিনে সুলতানের সাথে শাহাবুদ্দিনের মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।
সুলতান পুনরায় ফিরে আসলে যে ভাবে চড় মেরে তাকে ফেরায়, এখানেই পারবিনের উত্তরণ।
এখানেই পারবিন প্রেম ও শরীর দুটোকেই প্রত্যাখ করে আবার সারা জীবনের জন্য জয় করেছে।
এই আখ্যানের সাথেও আরো কিছু খুটইনাটি ঘটনার বিবরণ আছে যা মুসলিম পরিবার আচার
ব্যবহার রীতি এবং বাচ্চাদের শিক্ষা প্রদান রীতি এসবের আলাপও আছে। যা পাঠকে
ইনফরমেশন দেবে।
এবং এই উপন্যাসে আর যেটা পাঠকে আকর্ষণ করবে, সেটা হল এর
ভাষা ও পারবিনের জবানে লেখকের গল্প কখন রীতি। গোটাটাই পারবিন বলেছে, এক নাগাড়ে
কবিতার মতো বিরামহীণ ভাবে,স্বচ্ছ ভাবে, আড়ষ্টতা কাটিয়ে রাখঢাখ না করে। পরিবার,
নিজের সম্পর্কে, সমাজ ধর্ম শিক্ষা নীতি, পুরুষের যৌন বাসনার স্বীকার তার এই
খোলামেলা স্বীকারোক্তির সাবলীল বর্ণনা পাঠকে মুগ্ধ করবে।
বাংলাদেশের বর্তমানে যাঁরা লিখছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম
শক্তিশালী কথাকার হলেন জাকির তালুকদার। মূলত আশির দশকের শেষের দিকে তাঁর প্রথম
গল্পের বই বের হয়, নাম ছিল ‘স্বপ্নযাত্রা কিংবা উদ্বাস্তুপুরাণ’। বইটির প্রকাশ
কালছিল জানুয়ারি ১৯৮৮ তে। উপন্যাসে তাঁর
হাত পাকা। এমন কি ছোটগল্পকার
হিসাবে বংলাদেশে হাসান আজিজুল হকের পরে যদি কারো নাম উচ্চারণ করতে হয়, তবে তিনি জাকির তালুকদার। তাঁর গল্পসমগ্র পড়তে গিয়ে
অন্তত এই কথাই মনে হয়েছে। যদিও কেন এই গল্পসমগ্র, এর একটি কৈফিয়তও তিনি দেবার
চেষ্টা করেছেন, ‘আমার প্রথম চারটি গল্পের বই অনেকদিন থেকেই আর বাজারে পাওয়া যায়
না’। ফলত এমন সংকলন। এটি একটা উত্তর হলেও এই উত্তর কিন্তু পাঠককে তৃপ্তি দেবে না।
এই গল্পসমগ্র-এর মধ্যে যেটা পাওয়া যায়, গল্পকারের ‘ভূমিকার মতৈ কিছু-একটা’তে, সেটি
হল – ‘আমার নিজের সৃজন-গতিপথ সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা পাওয়া গেছে’ যেমন তেমনি
‘ছোটগল্পের বিষয় এবং আঙ্গিক নিয়ে এত বিচিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা’ ও ‘সঠিক বিষয়ের
জন্য সঠিক আঙ্গিক’ ইত্যাদি ছোটগল্পকে নিয়ে যে বিচিত্র পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ছিলেন
বিষয় ও আঙ্গিক নিয়ে, সে সবেরই নিদর্শন এই গল্প স্নগকলনে পাওয়া যায়। এই গল্পসমগ্রে
১৯৮৮ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত মোট পাঁচটি গল্পগ্রন্থের ৩৮টি গল্প ও অগ্রন্থিত ৩টি
গল্প অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। স্বপ্নযাত্রা
কিংবা উব্দাস্তুপুরাণ, বিশ্বাসের আগুন, কন্যা ও জলকন্যা, কল্পনা চাকমা ও রাজার
সেপাই, হা-ভাতভূমি, মাতৃহন্তা ও অন্যান্য গল্প – এই গল্পগ্রন্থ গুলি আছে।
‘পিতৃপরিচয়’ গল্পটি বংলাদেশের স্বাধীনতার সময়ে মেয়েদের
উপর যে নৃষংশ অত্যাচার এবং পিতৃ পরিচয়হীন
সন্তানের দেখা যাচ্ছিল, তেমন একটি সন্তানের আখ্যান এটি। ‘দেশ তখন কেবল স্বাধীন
হয়েছে। ... মানুষের শরীরে তখন পাকিস্তানি সৈন্যদের অত্যাচারের জখমের দাগ’, সে সময়
ফকির আলির দোর গোড়ায় একটি পাগলি আসে মতৃগন্ধ নিয়ে। তার ছেলে দুলান। প্রাইমারি
স্কুলে ভর্তি নেয় না, কারণ পিতৃপরিচয় নেই তার। এই গল্পে একটি বিশেষ সুবিধে ভোগী
শ্রেণির কথা বলা হয়েছে, যারা দেশ স্বাধীনতা অন্দোলনের নাম-গন্ধে না থাকলেও মহান
সেজে স্বাধীনতার সমস্ত সুযোগ সুবিধে ভোগ করে। কালাম চেয়ারম্যান চরিত্রটি তেমন
উদ্দেশ্য নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে। দুলাল কালাম
চয়ারম্যানকে ভয় পায়, এড়িইয়ে চলে। কিন্তু কালাম চেয়ারম্যান যে তার পিছন ছাড়ে না।
ফকির আলিই মারা গেলে তার ভিটে কালাম চয়ারম্যান দেখল করে নেয়, যুক্তি তিনি নাকি
ফকির আলিকে থাকতে দিয়েছিল। বিদেশের সাহয্য, রেশন কার্ডের সুবিধা, ভূমিহীনদের
সরকারী টাকায় ঘর – এসব সুযোগ সুবিধা কালাম চেয়ার ম্যান দুলালকে দেখিয়ে নিজে ভোগ
করে। কারণ দুলাল ‘খানের পো’। আর চেয়ারম্যান ‘শ্যাখের পো’। মুজিব কোর্ট পরে এরাই
দুলালকে মেরে দিলে , স্বয়ং বঙ্গবন্ধু আসেন এক অপার্থিব জ্যোতি নিয়ে। আহত দুলালকে
কোলে তুলে নিলে দুলাল বলে
‘তুমি
আমার বাপ? তুমি আহাকে জমম দিছেন?
হ্যাঁ রে বাপ!
তাইলে এ্যাদ্দিন তুমি কুণ্ঠে আছিলেন? হামার যে বড় কষ্ট।
আমার অনেক সন্তান দুলাল। কোটী কোটি সন্তান। তাঁদের সবার
কাছেই যে আমাদের যেতে হয়। তারো যে অসহায়।
... হাতলে তুমি ফির চলি যাবেন হামাক ছাড়ে।
নারে দুলাল। আর তোকে ছেড়ে যাব না। তোকে আমি বুকে করে
নিয়ে যা। আমার স্ব সন্তানকে আমি
বুকে করে রাখব।’
এই রকম চোখ চশটসে আবেগ্ময়তায় পাঠক আপ্লুত হন।
গল্পসমগ্রের সমস্ত গল্প গুলো বাংলাদেশের মানুষের, সমাজের বধুবিধ সমস্যার গল্প।
গল্পকার এখানে শুধুমাত্র পাঠককে গল্প শোনাতে আসেন নি। লেখক পাঠকের একটা ইণ্টারশন
হয়েছে। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের , যা আজকের সময়ে মসস্ত সমস্যাস্বাধীনতারসময়ে মৌলবাদীদের যে অত্যাচার দেখা গিয়েছিল, বর্তমান সময়েও সেটি একটি নতুন ফরমেশনে বাংলাদেশের
সমস্যার কারণ হয়ে দাড়াচ্ছে।
‘আতশপাখি’ গল্পটি প্রবল ভাবে বাংলাদেশের জমিসমস্যা ও
মাক্সীয় মতাদর্শের বিস্তারের গল্প। গল্পের মধ্যে যে একটা আদর্শ আছে, তা কনফুসিয়াসের
আতশপাখির সংজ্ঞার মধ্যদিয়ে ধরা পড়ে, ‘ যাহার আদর্শে অগ্নিতে আত্মাহুতি দিয়াও সে
আদর্শ সঞ্চারিত করিতে পারে পরবর্তী প্রজন্মের শোণিতে, তাহারাই ফিনিক্স- প্রকৃত
আতশপাখি’। গল্পটি সিধু খুড়োর সাথে পরিচয়ের সূত্রে
সেই ছেলেটি যার সাথে লাল ঝান্ডার নিশান, হাতুড়ি কাস্তে,সাঁওতাল পল্লীর
মেহনত করা কিশান, তেভাগা, আলিপুর, ফরাদপুর, গোদাবাড়ি আলোড়ন এ সবই এসেছে। আর এসেছে
মহানন্দার বুকে ভাসমান ছেলেটির লাশ। ছেলেটি তো ‘ দুনিয়ার সরবহারা ... ’ আদর্শের
জন্য প্রাণ দিয়েছিল। সিধু খুড়ো শুলেছিলছেলেটার মুখে এক কম্রেডের থেকে লক্ষ কমরেড
জন্ম নেবে’। নিয়েও ছিল যখ সমবেত সাঁওতালরা সমস্বরে বলে উঠেছিল, ‘ আমরা সবাই কমরেড
হব, কমরেড হত্যার বদলা নেব’। প্রখর প্রতিবাদি চেতনার গল্প হলেও এই গল্প পাঠে একটা
কবিতার মেজাজ পাওয়া যাবে। ‘কল্পনা চাকমা ও রজার সেপাই’ গল্পের মধ্যে একটা রূপকথার
আবহ সৃষ্টি করে জমি, সংখ্যালঘু জনপদের ইতিহাস ও অস্তিত্ব সংকটের কথা, অত্যাচারের
কথা, তাঁদের সংখ্যালঘু হবার ইতিহাস, অত্যাচারের ইতিহাস – এই সব কথা বলা হয়েছে। গল্পটি
শুরু হয় মহাভারতের মত ধ্রপদী কাহিনি বলার রীতি দিয়ে। কল্পনার কথায় রাজা ভালো
মানুষ, সে তাঁদের জমি রক্ষা করবে। কিন্তু ভান্তে জানায়, ‘ এখন আর রক্ষক রাজআনাই।
এখন রাজা ভক্ষক। শয়তানের উপাসক। ... সে এখন জোরপূর্বক রাজা। স্বেচ্ছাচারী’।সেজন্য গল্পকার তথ্য দিয়ে দেখান ১৯৯২ সালের ১৩ই অক্টোবর
থেকে ২৬ এ অক্টোবর হাজার হাজার সংখ্যালঘু জুম চাষীর গণহত্যার ডায়েরি। ১৯৬৬ সালে
আইয়ুব খানের চিনা সফরের সময় অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট ফজলুল কাদের চৌধুরীর ‘এক্সক্লুডেড
এরিয়া’ নীতির ফলে চট্টগ্রামের হাজার হাজার উপজাতির ঘর বাড়ি জমি লুঠ ও দখল, জাতীয়
সংসদের সদস্য মানবেন্দ্র চাকমার ও বঙ্গন্ধুর বৈঠক, ১৯৭৯ থেকে ১৯৮০ এক লক্ষ, ১৯৮১
তে ও তারপরের সালে মোট তিন লক্ষ বাঙালির অনুপ্রবেশের ইতিহাস এখানে কল্পনা চাকমার
আখ্যানে যুক্ত করা হয়েছে। আর এরাই এক সময় এঁদের জমি জমা সমস্ত কিছু কেড়ে নেয়।
ধর্ষণ করে। বাড়ি ঘর জবালিয়ে দেয়। এবং প্রতিবাদী সত্যাকে হত্যা করে। কিন্তু
প্রতিবাদের মরণ হয় না।
‘কল্পনা চাকমার পালা আসে।
রাজার সেপাইরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। আর রাজা তাকে
হাড়-মাংস-চুল-নখসহ গিলে খায়।
রাজা জানে না, কল্পনা প্রস্তুত হয়েই এসেছিল। নিজের সমস্ত
শরীরে-মনে বিষ মিশিয়ে রেখেছিল। পাহাড়-জঙ্গলে প্রতিমুহূর্তে তৈরি হয় এই বিষ। সবচেয়ে
মারাত্মক বিষ। নিপীড়িত আত্মার অভিশাপ। এই বিষ তার কাজ করবেই। দেরিতে হলেও।
‘পণ্যায়নের ইতিকথা’ গল্পেও দেখি প্রতিবাদ। তবে এর ধরণ ও
ধারণ আলাদা। সত্যমেম্বারের বাড়ির উঠোনটা কসমোপলিটন উঠোন হয়ে উঠেছে কারণ বিভিন্ন
দেশের রাষ্ট্রদূত, যেমন নরোয়ে ইত্যাদি, এদেরকে দেশের ‘ইন্ডিজেনাস পুয়র’ পিপিলকে
দেখিয়ে এন জি ও’র নামে টাকা হড়প করতে চায়। কথা না শুনলে জোর করে নিয়ে আসে। প্রথমে
তারা আসতে না চায়লে আসতে বাধ্য করা হয়, এমন কি গুন্ডা দিয়ে তুলে আনা হয়। তৃতীয়
বিশ্বের দেশ গুলোতে প্রথম বিশ্বের কাছ থেকে এন জি ও’র নাম করে বযাক্তি স্বার্থ
চরিতার্থ করার জন্য যে চক্রান্ত, তা এই গল্পের মধ্যে দেখা যায়। গল্পের মধ্যে মোড়
আসে উত্তরপাড়ার আলতাফ মাস্টার, যে কমিউনিস্ট হিশেবে পরিচিত, চার শিখিয়ে দেওয়া
পাল্টা মারের মধ্যে। গল্পের মধ্যে এটা স্পষ্ট হয় যে, বাংলাসেশের আগামী দিনের
মানুষের মুক্তির পথ এই কমিউনিস্টরা বাতলে দেবে। আনেকের কাছে এই গল্পটা পাঠের
প্রতিক্রিয়া হিশেবে বক্তব্য প্রধান গল্প হিশেবে মনে হলেও মানূষের মুক্তির কাছে এই
বক্তব্য ফিকে হয়ে দাঁড়ায়। মনে হতে পারে গোটা বিশ্ব আসলে ভোগের পণ্য ছাড়া আর কিছুই
নয়। এছাড়া ‘ আজগর আলির হিসেববিজ্ঞান’, ‘তিন ভাগ জল’, ‘ক্রসফায়ারের আগে’ – এই সব
গল্প গিলো পাঠকের বিশেষ আকর্ষণের দাবি রাখে।
( ২য় কিস্তি পরবর্তী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে )
( ২য় কিস্তি পরবর্তী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে )
২য় কিস্তি পড়ার ইচ্ছে রইল। :) গল্পের আলোচনার মাঝে দুএকটার প্রসঙ্গ না এনে উপন্যাস নিয়ে আলাদা করে এরকম আলোচনা প্রকাশিত হলে খুব ভালো লাগবে।
ReplyDeleteEkane ekta purno uponas r upor leka chilo. Nam ta sampadoker deyo. Surota choto galpor katha thakelo akimun rahaman uponas ta ache. Nam ta Boi alocona thakle valohoto. Apnar matamotke sagot janachi
ReplyDelete