“অনেক আগুন ভেতর ভেতর জ্বলে”
অনির্বাণ ভট্টাচার্য
‘আকাশের জন্ম ১৯৯৪-এর
বর্ষায়’। হ্যাঁ, শেষ মলাটে এভাবেই পরিচয়পত্র শুরু করেছেন আকাশ - আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়।
বর্তমানে বিজ্ঞান শাখার তৃতীয় বর্ষের ছাত্র উত্তরপাড়ার আকাশ ‘মাস্তুল’ পত্রিকার
সম্পাদনা করছেন। ২০১৬য় পাঠক থেকে প্রকাশিত তাঁর বই “আরও গভীরে মেঘ” কিন্তু
একেবারেই বলছেনা এটি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ধারে ভারে বেশ পরিণত, বহুমুখীন অথচ
বহুর ভিড়েও বেশ অন্যরকম।
আকাশ জানেন “পরিবার
আসলে তো নদী”, আকাশ বোঝেন “অনেক আগুন ভেতর ভেতর জ্বলে”।
সেই আকাশের লেখাই কখনো
ভীষণ মায়াবী। সেখানে প্রেয়সীকে ডাকার সুরেও কিছুটা তুলনায় এসে যেতে পারে ‘মেঘবালিকার
জন্য রূপকথা’র সুর। “একটা বিকেল আঁকব খাতায়/যেঁই বিকেলে চৈতি-আমি/নদীর পাড়ে ঘাটের
সিঁড়ি/গজিয়ে ওঠা বট পাকুড়ে/পুঁতব চিঠি শিকড় খুঁড়ে...”। এই আকাশ একইসঙ্গে কবিতার ডিটেইলগুলোর
ওপরেও বেশ সতর্ক। “সেখানে কোনোদিন সন্ধে হয় না/সেখানে কেবল আলো নেভে’ – কবিই তো
পারে সুক্ষ আঁচড়ে এর ফারাকটা ধরতে। বেঁচে থাকার ক্রাইসিসটা, ভাবতে অবাক লাগে মাত্র
বছর বাইশের আকাশ কিভাবে সেটাকে ধরে নিলেন। কেমন অবলীলায় লিখলেন – “কেউ দেখতে পায় একটা
রান্নাঘর, যার/অন্যদিকটা শ্মশান পর্যন্ত বিস্তৃত”, অথবা “তোমার সুখের ভিড়ে আমার
প্রখর সন্দেহ” কিংবা “এক দরজা দূরত্বে কেশে ওঠে অপত্য,/তুমি ছুটে যাও আশঙ্কায়/আমার
আর চেনা হয়ে ওঠে না/মাঝরাতের তোমাকে”। তবু, একদিক থাকে দেখতে গেলে “আরও গভীরে মেঘ”
আসলে এই ক্রাইসিস, কষ্ট, না পাওয়া মিলিয়েই একটা নিটোল প্রেমের কবিতার বই। সেখানে
মেদহীন কিছু উচ্চারণ রেখে যান আকাশ। “কোনো কোনো রাতে/মাটি অব্দি নেমে দেখো উজ্জ্বল
থাকো কিনা” বা “আলতো হাতে একটা সামান্য ঝাঁকুনি দিয়ে বলে –‘ওঠো’!” আবার কখনো কবিই তীব্র
স্পষ্টবাদে সময়কে ধরেছেন – “কী হবে তোমার নিশানায়? দেশ জিতবে, পৃথিবী জিতবে
তারপর?” কিংবা “বিশ্বাস? সে তো ঘাতকের প্রতিশব্দ”। খুব সহজেই গল্পের ছলে কবিতাকে
এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার রীতি তৈরি করে দিয়েছেন আকাশ। সেখানে লক্ষাধিক মায়ের চুল
আঁচড়ানোর দৃশ্য যেমন শেষমেশ একটা লম্বা চুল জামায় লেগে থাকার আখ্যান তৈরি করে
তেমনি লাইনে একটি করে লোককে সামনে যেতে দিতে দিতে প্রতিসপ্তাহে কত ট্রেন ছেড়ে
যাওয়ার ক্লাইম্যাক্সে এসে ঠেকে কবিতা। গদ্য কবিতায় খুব সাবলীল্ভাবে ঘোরাফেরা করলেও
কবি খুব সচেতন নিখুঁত অন্ত্যমিলেও – “যখন মেজাজ ভালো থাকে, বলে দুটো নে/মায়ের
আঁচলে গিঁট বাঁধা ছিল বাতাসা/এসব বর্ষা ভুল করে আসে উঠোনে”। আসলে বেঁচে থাকাটা শুধু
তো ক্রাইসিস না, তার মধ্যে দু এক পশলা মায়াও কাজ করে। আকাশ খুব সহজে সেটা ধরতে
পেরেছেন – “আমরা অমাবস্যা বলি/গেলে তো যাওয়াই যায়/চলে যেতে ঠিকানা লাগে না” কিংবা “নতুন
রাস্তায় যেতে যেতে থমকে দাঁড়াই,/ঢোলা প্যান্ট পরে,/অপেক্ষা করি/এবার পকেটমারি
হোক”। পঙক্তিতে সেই মায়া চলকে চলকে ওঠে।
এককথায় ২০১৬র কলকাতা
বইমেলার অন্যতম প্রাপ্তি “আরও গভীরে মেঘ”। তৌসিফ হকের প্রচ্ছদ শিল্পিত এবং যথোপযুক্ত,
একইসঙ্গে নাম এবং বিষয়বস্তুর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক। সবমিলিয়ে কবির নিজের ভাষায় যেমন
“ধ্রুবতারার লাজুক চোখে একফোঁটা জল”, তেমনি কবি পরিচিতি এবং সর্বোপরি বইটির পাতায়
পাতায় জ্বলজ্বল করা হলদে পাঞ্জাবির আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়ের লাজুক চোখে যে বাংলা
কবিতার ভবিষ্যৎ আঁকা হয়ে গেছে, এব্যাপারে সন্দেহ নেই।
No comments:
Post a Comment