Tuesday, July 5, 2016

উইন্ডো সিট থেকে / সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়



উইন্ডো সিট থেকে : ব্যাপ্ত পৃথিবীময় কবিতা


যশোধরা রায়চৌধুরী


জীবন বেয়ে উঠতে গিয়ে টের পাই,
কী তুমুল নীচে নামাচ্ছে জীবন...তালা  খুলে ঘরে ঢুকে দেখি
নিভন্ত সোফার পাশে আমাদের ছায়া বসে আছে।
...
শনিবারগুলো রবিবারে গড়িয়ে গিয়ে
সোমবারের ভেতর ঢুকে  পড়ে
অজানা বিপন্নতার মতো 
(পুরনো হাসির শব্দ)

আপাত সরল একটা বয়ান। কথাগুলো আলাদা করে দেখলে প্রতিটাই কতগুলো আলাদা আলাদা ছবি। অথচ সবটা একসঙ্গে যখন আসছে, তোইরি হচ্ছে একটা ট্যারচা , উল্টোপাল্টা, অদ্ভুত ছায়ার শব্দজাল। যার ভেতরে চিনে নিতে থাকি আমার চেনা পৃথিবীকেই। আরো স্পষ্ট করে। সেই পৃথিবী যেহেতু ভুবনায়িত, ও উন্মাদ, তাকে ধরতে শব্দগোলকটিও ততোধিক ব্যকরণহীন। হয়ত বা, অধুনান্তিক, যাকে সাদা বাংলায় বলে পোস্ট মডার্ন।

খায় না মাথায় মাখে এই পোস্ট মডার্ন?

বরং সহজ করে বলা যাক। ভাবা যাক।  একজন কবি একবার বলেছিলেন, আমি গদ্য লিখি সর্বসাধারণের জন্য, প্রবন্ধ লিখি পন্ডিতদের জন্য, আর কবিতা লিখি নিজের জন্য।

এই কথা বলবার সঙ্গে সঙ্গে সেই বিখ্যাত ইউরোপিয় লেখক, একটা আলাদা তাক তৈরি করলেন কবিতার জন্য। আর, মজার কথা হল, এই কবিতাই এমন এক পণ্য যার বাজারমূল্য হ্রাস পায় ততটাই, যতটাই কবি হয়ে ওঠেন আত্মগত। কবির নিজের জন্য লেখা যত বেড়ে চলে, পাঠকপ্রিয়তা ব্যস্তানুপাতিকভাবে হ্রাস পায় ।

পাঠকপ্রিয় কবিতাকে “তত ভাল কবিতা নয়” বলবার যে প্রচলন, তা কিন্তু বহু যুগ ধরে নয়। এরও এক ইতিহাস আছে। রচিত ইতিহাস না হলেও। অন্যদিকে ফেবল, ব্যালাড, পাঁচালি, কথা, গান, এসবের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত জনপ্রিয়তম কবিতাও “কবিতা নয়” এমন তো নয়।

তবু, বিগত দুই শতকের পাঠ অভিজ্ঞতা থেকে, আমরা পেয়েছি, শিল্পের সবচেয়ে উৎকর্ষের জায়গা কবিতাকে দেবার একটা আলাদা বোধ। আর সম্ভবত এই বোধের ছিটেফোঁটাকে সম্বল করেই আজকের দিনে লিখতে শুরু করেন কোন কবি।

যখন নিজের জন্য লেখে কবি, তখন তার কাছে অন্যরা, পাঠকরা, আসে পরের স্তরে। নিজের টার্মসে খেলেন কবি, তাঁর কাছে অন্য কোন হিসেব নেই তখন। যে পড়বে তার দায় কবির লিখিত হেঁয়ালি অথবা গোপন লিপিচিত্রকে ডেসাইফার করার। যেভাবে গোয়েন্দা পড়েন গুপ্ত লিপি, সেভাবে আমরা পড়ি কবিকে, তখন। আর পড়তে পড়তে দেখি আমাদের পাঠ নিজেদের রাস্তা করে নিচ্ছে।

সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়র বই ‘উইন্ডো সিট থেকে’। তৃতীয় মৌলিক বই ।

গভীরতায় এক বই থেকে অন্য বইতে একধরণের প্রগতি আশা করা আমাদের অতিপুরাতন ব্যাধি। যদিও ব্যাপ্তির দিক থেকে সৌভিক চিরকালই অনেকটা আশা জাগায়।  অন্তত প্রথম বই থেকে প্রতিটি বইই পড়ার আমার অভিজ্ঞতা থাকায় বলতেই পারি, যে, তার কোন খামতি নেই নিজেকে অনেক দূর অব্দি টেনে নিয়ে যাওয়ায়। এ ক্ষেত্রে শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় বা তারাপদ রায়, পঞ্চাশ দশকের এই দুই দুরন্ত, অনাবিল, অতি ব্যাপ্ত আকাশের কবির কথাই মনে পড়ে, তুলনায়। বিষয়ের বৈচিত্রে ও আপাত সরল চলনে পৃথিবীকে এক লপ্তে ধরে নিতে পারার এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রয়াস সৌভিকেরও।

এক অর্থে এই তৃতীয় বইতে তার সঙ্গেই সে অধিকার করেছে এক বিষণ্ণতার স্বর, এক ধরণের অ্যাংস্ট। এই বয়োধর্মটি হয়ত প্রার্থিতই ছিল।
যেমন পম্পেই কবিতাটিঃ

লুম্পেন শহর থেকে
মেঘলা কলেজ স্ট্রিটে
চিরকুট ছুড়ে দিল কেউ।

মৃত মানুষের মিছিল এখানে,
ধূসর চায়ের দোকান,
ভুটানি সোয়েটার কেউ কেনে না এখন, ওয়েলিংটনে।

এই বিষাদ ব্যক্তিবিষাদ ও শহরবিষাদও বটে। নস্টালজিয়া ও এগিয়ে চলার টানাপোড়েন আগেও দেখেছি সৌভিকের কবিতায় তবু এতে আরো বেশি বেশি করে সিপিয়া রঙ আসছে।

“জটিল অঙ্কের মতো মেঘ
ঢেকে দেয় কলকাতা স্কাইলাইন
ভাসমান দু-একটা চিল
তড়িঘড়ি ফিরতে চায় ঘরে।
সেপিয়া আকাশ জুড়ে ফুটে ওঠে
কাঁপা কাঁপা জলছবি – বৃষ্টিতে ভেজার সময়
হঠাৎ আটকে পড়া গ্লোব সিনেমায়। ...“ 
(উইন্ডো সিট থেকে)

ভাষায় একাধিক কাজ করেন তিনি। প্রথমত হিন্দি ইংরিজি বাংলা সব বুলি একসঙ্গে মথিত হয় তাঁর কবিতায়। এই ভাষা মিশ্রণ, আমরা জানি, আজকের প্রতিটি দিনের অবক্ষয়।  অথচ, কবিতায় এই ধরনের পরীক্ষামূলক ভাষামিশ্রণ কবিতাকে দেয় এক ঋদ্ধ বয়ন।

যখন  বলছি যে কবি শুধুই ভাষা নিয়ে থাকবেন, তাকাবেন না বাইরের দিকে, তখনও কি ঠিক বলছি? বাইরের পৃথিবী কি ভাষার আর শব্দের মধ্য দিয়েই লাট খেয়ে এসে পড়ছে না আমাদের মস্তিষ্কে? তাকে ঠেকিয়ে রাখবেন কেন কবি? তাকে বর্ণনাও করবেন না তিনি। শুধু তার থেকে ছবি তুলে নিয়ে নিয়ে এক দ্বিতীয় পৃথিবী তৈরি করবেন।

মৃত বাড়ি, বড় ঘুম, ফুল পাঞ্জাব লরি, ট্যাক্সিওয়ালা, মিসেস চ্যাটার্জি, হর্ষিতা অরোরা অথবা ভিজিটিং আওয়ার্স...  সৌভিকের কবিতার ভেতরে  সমস্ত পৃথিবী ঘুর্নি খেয়ে এসে পড়ে । এই উপাদান এসে পড়াটা খুব লক্ষ্য করে দেখার মত। কেননা, “আত্মকেন্দ্রিক” বলতে যা বোঝায় তা কিন্তু এই কবিতাগুলি আদৌ নয়। কিন্তু সমাজ সচেতনতা, সমাজবাস্তবতা ইত্যাদি ইত্যাদির কোন মহান মোহ তাঁর শব্দচয়নে কাজ করেনা। তাঁর শব্দচয়ন মূলত শব্দসংস্রব, শব্দসহবাস, শব্দদের নিয়ে তুমুল খেলাধুলো।

এই সব কবিতায় অতিরিক্ত বিষয় নিয়ে সন্দিগ্ধ যে পাঠক, কবিতার ভেতরে কবিতা খুঁজতে থাকা পাঠক, তাঁদের প্রত্যেকের মধ্যে তার বাঁধা হয়, যোগাযোগ ঘটে। কবিতাকে আলাদা করে দেখতে চাওয়া পাঠক, আবার কবিতা নামক একটি বস্তুর অবয়বও দেখতে পান যেন। ঝাপসা আদলে।

তবে এই বইতে যে মাত্রাবৃত্তের অতি কতিপয় কবিতা আছে, সেগুলি অন্যরকমের, হয়ত সৌভিকের এই ক্ষেত্রেও ক্ষমতাটি তিনি দেখিয়েছেন সফলভাবে। কিন্তু তাঁর আসল এলাকা গদ্যধর্মী কবিতাই। শ্রেষ্ঠ উদাহরণ বোধ হয় “চাবুক” আর “সেফটিপিন”।

পাঠকের পড়ার জন্য এই বই রইল। খুলে খুলে পড়ার আর মজে যাওয়ার জন্য । 



                  উইন্ডো সিট থেকে  /  সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় / ধানসিড়ি  



No comments:

Post a Comment