Tuesday, July 5, 2016

সম্পাদকীয়



প্রায় একবছরেরও বেশি সময় হয়ে গেল যখন শুরু করেছিলাম কবিতা সংখ্যা দিয়ে অলিন্দ’র এই ব্লগ। এরপর ব্যস্ততা দৈনন্দিন, একে একে লিটল ম্যাগ মেলা, বইমেলা, নতুন প্রিন্টেড সংখ্যার চাপ, দিনলিপি বয়ে যায়। মাঝে মাঝে ব্লগের কথা আনমনে, দ্বন্দ্ব চলে নিজের ভিতর, একটা হালকা অবজ্ঞা করা বাস্তব, প্রিন্টেড না ওয়েব, ওয়েব না প্রিন্টেড! ডিসিশন নিতে দেরি হলেও আমরা হারিয়ে না যাওয়ার চেষ্টায়। কিন্তু কী হবে নতুন সংখ্যার বিষয়? এত এত ওয়েবে কত শত এমবি তো প্রতিদিন তো ভরে যাচ্ছে গল্প আর কবিতায়, কোথাও বা দুর্ধর্ষ কোলাজ, উপন্যাস নিদেনপক্ষে মন ফাটিয়ে দেওয়া মুক্তগদ্য। তবে কি হবে?
ঘুরে ফিরে চলে আসি নিজেদের বাস্তবতায়।  কত শত বই যে বেরুল এই এ বছরও, তাঁর হিসেব কত জন ‘পুশি’য়ে দেওয়া পাঠকইবা রাখে! দীর্ঘশ্বাসের শব্দ জানে শুধু ঘরের দেওয়ালের কোণ আর বইয়ের র‍্যাকের পিছন। ক্যুরিয়ারের খরচা বাড়ে, উত্তর আসে হাতের চেয়েও কম গোনা। রোববারের পেপারের ভিড়ে শুধু পকেটই খালি হয়। বড় পাতায় বইয়ের ছবির শিকে তো সব বিড়ালের ভাগ্যে জোটা সম্ভব নয়। কিন্তু পাড়ার কাকু সে কথা বুঝলেও আমি তো বুঝি না!
স্বীকার না করলেও প্রত্যেকেরই একটা ইচ্ছে থাকে নিজের সন্তানকে অপরের চোখ দিয়ে দেখার। আর সে সন্তান যখন ছাপার কালিতে মাখিয়ে যায় তখন সে ইচ্ছেটা কিছুটা দাবিতে বদলে যায়। আর কোন দাবিই কখনও মিথ্যে নয়, না হয় সবার হয়না পূরন সবসময়। বিষয়টা ভাবায় মানে ভাবিয়েছে মানে ভাবাচ্ছে। আমাদের জন্য মূল্যায়ন কি সবসময় মৃত্যুর পরের অধিকার হয়েই রয়ে যাবে!!
সঠিক মূল্যায়ন কেই বা পারে করতে! কেই বা এজীবনে সঠিক! না পারি যদি সেই অক্ষরগুলোকে যথার্থ প্রণামী দিতে তবু শুধু চেষ্টা করে যাই তাদের কাছে মাথা নত করে নূন্যতম সন্মান টুকু জানানোর - ভাবনা থেকেই এই বই রিভিউ সংখ্যার সূত্রপাত।
হটাত করে নেওয়া ডিসিশন আর দুমদাম কাজ শুরু। তাই বই বাছতে গিয়ে আমরা আবার ফিরে আসি বন্ধুদের সাহায্যে। এই সংখ্যায় সাহস যুগিয়েছেন অনেকেই, অনেকেই তাদের কিমতি সময় নষ্ট করে অনুরোধ রেখেছেন আমাদের। সকলকেই অনেক অনেক ধন্যবাদ। তবে এই সংখ্যাটা যাকে ছাড়া সম্ভব হত না সে হল বৈদুর্য্য সরকার। মূলত ওর সাহায্য ও উৎসাহ ছাড়া সংখ্যাটিকে বাস্তবায়িত করা যেত না। পাঠকের উৎসাহ ও সাহায্য পেলে ইচ্ছে থাকলো ভবিষ্যতে আরও বেশ কিছু ‘বই রিভিউ’ সংখ্যা প্রকাশ করার।

আমার নাম আইরিন / শীর্ষেন্দু দত্ত



ইচ্ছে বদলের আইরিনঃ পুনর্ভবতা, পুনর্পদায়ন ও পুনরাখ্যায়ন



সৌগত বালী


“ আমি আর ওলি। অথবা, ওলি আর আমি, আসলে আমি বলতে চাই যে , আমি ওলিকে পছন্দ করি। বা আমার ওলিকে ভালো লাগে...আর ওলি? ওর কি আমাকে ভালো লাগে? একটু আধটু যে লাগে না তা নয়। তবে প্রথম দিন থেকে ‘ভালো লাগে’ বলে ফেলাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যেতে পারে। বরং গল্পটা আরেকটু এগোক।” তো এগোক।

আমি অরুন আইনকে চিনি না, যাকে দেখে আপনার লিখতে ইচ্ছে করে। আমি শুধু দেখতে পাচ্ছি ছাইরঙা আলোয় ক্লীবলিঙ্গ হয়ে বেঁচে থাকা আইরিন নাম গল্পকে ইঙ্গিত করে বলে যাচ্ছে, “ আমরা তিনজন লিফটে করে নেমে এলাম একদম গ্রাউনড ফ্লোরে। শেষবারের জন্য।” এভাবে আমরা ক্রমাগত নেমে আসছি, এই সমবেত নেমে আসা কী? বলতে পারেন ওলি? শীর্ষেন্দু বাবু, দেখুন আপনার মাথা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মরফিং হয়ে যাচ্ছে আপনার মুখ; এখন আপনি অনিন্দ্য কিমবা...রেড ওয়াইনের বোতলটা উঠে আসছে মাথার ওপর।

এতো উঁচু থেকে সিলিং দেখা যায় না, আইরিনদের সমবেত স্বর ভেসে আসছে, লেখক শীর্ষেন্দু দত্তের লেখা ‘আমার নাম আইরিন’ গল্প সংকলনটি এমনই বহুস্বর যুক্ত। গল্পগুলো পড়তে পড়তে মনে হয় একটা মাল্টিভোকাল ধ্বনিত হচ্ছে প্রেক্ষাপট-এ। এ বিষয়ে গিলে দ্যলুজ (Giles Deleuze) ও ফেলিক্স গুয়াতারির (Felix Guattari)  একটি উচ্চারন মনে পড়ে যাচ্ছে;

“Who speaks and who acts? It is always a multiplicity. Even in the person who speaks or acts. We are all little groups. There is no longer representation, there is only action. The action of theory, the action of practice in relations of ways-stations or networks.”


সংকলনটির সাত নম্বর গল্পটিতে থমকাতে হয় আবার। ‘আমি ও আমার আসন্ন বাপ মা’ গল্পটির নামকরণ বলে দিচ্ছে আরেকটি ভ্রুনের গল্পের কথা। কিন্তু গল্পের মাঝ বরাবর এসে যখন নবারুণ ভট্টাচার্য কে দেখা গেল বেজন্মা ভ্রুনের টিকিট বিলি করতে তখন আশ্চর্য হতে হয়, আর এখানেই গদ্যটির এতদিনের গড়ে ওঠা ধাপে ধাপে নির্মাণের লিনিয়ারিটি ভেস্তে গেল আর একইসাথে পোষ্ট কলোনিয়াল পৃথিবী দৃশ্যতা পেল। এই যে আমাদের চারপাশ ক্রমবিন্যাস-এ হয়ে উঠছে ভারচ্যুয়াল। সামনের মানুষটি নিয়ম মাফিক কাজ করে যায় অথচ স্পষ্টত বোঝা যায় সে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এই অসৎকণায় ভরা চারপাশ আবছা মিথ্যে। একটা ফ্যালাসির মতো অথচ বিরল দগদগে ঘা গজিয়ে উঠছে চামড়ায় আর মাছি উড়তে থাকে। সমাজ, সভ্যতার এইসব বিরল ক্ষতর বিশুদ্ধ উচ্চারন ‘ আমার নাম আইরিন’ । ধন্যবাদ গদ্যকার শীর্ষেন্দু দত্ত কে, উনি আমাদের চিরাচরিত গদ্যের ক্লান্তি থেকে মুক্তি দিচ্ছেন।

পুনশ্চ কটি কথা গ্রন্থটি ওলটালে লেখক পরিচয়ে সন্দীপন, নবারুণ, উদয়ন –এর উচ্চারন লেখক শীর্ষেন্দু দত্ত-কে একটা প্যারামিটারে বেঁধে দেয়। যেখান থেকে মনে হয় গদ্যকার শ্রী শীর্ষেন্দু দত্ত কোনও পূর্ব প্রভাবিত লেখকের নাম। বিষয়টি নিন্দনীয়। এর মধ্যে দিয়ে সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু দত্ত-এর শিল্পকর্মগুলি খাট করা হয়েছে মনে করি।

আশা রাখি ‘ আমার নাম আইরিন’ ভবিষ্যতে একটা উপত্যকার নাম হবে।


আমার নাম আইরিন / শীর্ষেন্দু দত্ত / নতুন শতক প্রকাশনী,  কলকাতা-৭০০০২৯

যোগাযোগঃ ৯৮৩০৯০৭৭৯২



সন্ত নিকোলাসের হাড়গোড় / অনির্বাণ ভট্টাচার্য



কবিতার অনির্বাণ হাড়গোড়


বৈদূর্য্য সরকার


উৎসর্গ পত্রে অনির্বাণ লিখেছে “মৃত্যু নিবি না?” পড়ে কি থমকে যাইনি ! বইটা হাতে নিয়েও কম অবাক হইনি, সেঁজুতি দাশগুপ্তের প্রচ্ছদের কারণে । লাল রঙটাকে যে এভাবেও ব্যবহার করা যায়, সেটা দেখে । শুভ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশিত বইটির প্রোডাকশানের মান প্রশংসনীয় । হয়তো অনির্বাণের আত্মবিশ্বাস ছিল, শোভিত বুকশেলফে জায়গা পাবে তার বই । কিন্তু সেটা যে তার গন্তব্য নয় কবি বুঝিয়ে দেন মুখবন্ধে নামহীন কবিতার  দ্বিতীয় স্তবকে-

“আশ্চর্য ভাতের গন্ধ গোটা দেশ জুড়ে
 তেতো শেকড়ের স্বাদ, পিঁপড়ের ডিম খেয়ে বাঁচা 
 সারি সারি মানুষের রেবেল...
 তোকে কালাহান্ডি নামে ডাকলে কতজন বুভুক্ষু সাড়া দেবে?”

সমাজতন্ত্র কিংবা জীবনানন্দের কবিতা, যৌথখামারের স্বপ্ন কিংবা মৃত্যুর স্বাদ কোথাও মিলেমিশে যায় অনির্বাণের অধুনান্তিক কবিতায় । 

“হে ঈশ্বর, দেখে গেলে না
 এ শহর আবার গর্জে উঠছে
 বিপ্লবে বা চৈত্র সেলে।”

... পড়ে মনে হয় বাজার সর্বস্ব দুনিয়ায় পরম শক্তিশালী বাজার অর্থনীতিকে কবি এড়াতে পারেনি, যেমন ভুলতে পারেনি পেছনে পড়ে থাকা মনে করা লোকেদের গ্লানি –

“পড়ে থাকি আমরা,
 যারা উৎসবের রাতে
 নিজস্ব নারীকে দেখেও ভালোবাসতে পারি না ...”

‘বছর শেষের রাতে’ কবি শোনে অবহমানের ডাক- “বাইরে প্রতীক্ষমাণ তুমি, আসছে ও আসছে” । কবি ‘কোথাও একটা’ নিশ্চিন্ত জীবনের আশায় থাকে, খেয়েপড়ে থাকার সেই শাশ্বত গল্পের খোঁজে থাকে, তবু কোথাও যেন আশ্রয় মেলে না-

“আমিও কাঙাল, একথালা ভাত ঈশারায়
 ভেতরে ডাকছি, ছিটকিনি তুলে দিস। ”

কবির ‘ভাতের গন্ধ ইচ্ছে করে’ কিন্তু সে গন্ধে মিশে যায় রক্ত যৌনতা কিংবা সামাজিক মুক্তির গল্প –

“দু-মুঠো ভাতের ঘ্রাণে ঢেলে দেব
 তোর শরীর খারাপের রক্ত ।”

 ‘ভালোটি আছি’ লিখেও কবি আসলে ভালো থাকে না । সামাজিক উদাসীনতায় জীবন তাকে বাধ্য করে লিখতে –
“ততটাই কাতর আমার চিৎকার
 অথচ দ্যাখো, কীরকম চুপটি হয়ে গেছি...”

‘সেই অসুখী লোকটা’র কবি আসলে  শূন্যতাকে নিয়তি ভেবে, না পাওয়াকে নির্দিষ্ট ভেবে নির্লিপ্ত উচ্চারণে বলে ওঠেন –
“ঝুট হ্যায়, সব ঝুট হ্যায়”

বলার অপেক্ষা রাখে না কবির গেরস্থালিতে মেশে প্রেম, শরীর,  সম্পর্কে উদাসীনতা নয় খুঁজে পাওয়া যায় গভীর আশ্লেষ

“তোকে নগ্ন করে,
 শেখাব গলা দিয়ে ভাত, মাসমাইনে
 অথবা পুরুষাকার... কোথায় কতটা ঢোকে”

কবি বোঝেননি গারস্থের সমীকরণ, কখনও উদাসীন থেকেছেন মাত্রার হিসেবনিকেশে তবু বুঝেছেন পারিপার্শ্ব তাকে পুতুলখেলা রান্নাবাটির জগতে কিভাবে গিলে ফেলে আস্তে আস্তে -

“অক্ষরবৃত্তে আমার হাঁটা হয়নি ঠিকমতো
 তবে হেঁটে গেছে গেরস্থালীর পোকারা
 আমার তেলচিটচিটে পৃথিবীতে ...”

তাই মায়ায় জড়ানো জিবের মতো মনে স্বাভাবিক বংশগতির তত্ত্ব উঠে আসে, ছাপোষা পিতার জিজ্ঞাসায় সে প্রশ্ন করে
“ও কি আর আমার মতো হবে?”

কবির মন পরে থাকে কৈশোরের স্বপ্নে, উল্টো দিকে ছুটে  ফিরে পেতে চায় শারদীয়ার গল্প –

“সেই কবে মরে গেছে কিকিরা
 আর কাকাবাবু হলদে চোখে দরদাম করছেন”

ব্যাক কভারে কবির সংক্ষিপ্ত জীবনী থেকে জানা যায় ৮৩’ তে চন্দননগরে জন্ম,বিশ্বভারতী ও যাদবপুরে শিক্ষা, প্রসার ভারতীতে বর্তমানে কর্মরত । এছাড়াও তার লেখালিখি সখ আহ্লাদ ইত্যাদি। বোঝা যায় এটা নতুন গড়ে ওঠা প্রকাশনীর বিপণন কৌশল। কারণ পাঠকের কাছে এসব গৌণ হয়ে যায় কবি যখন প্রথম ‘ক্রিসমাসের কবিতা’য় তৃতীয় বিশ্বকে মিশিয়ে দেয় ইতিহাস কিংবা মিথের সাথে, হয়ত কিছুটা মনকেমনের  অভিব্যক্তিতে – “টান পড়ছে গল্পে, সাবেকি ঠাম্মাদের ছেড়ে ...” এখানে বোধহয় কবির ব্যক্তিগত কিছু অপ্রাপ্তিও মিশে থাকে, ‘রূপকথার গল্পে’ সব রেফারেন্সে অনুপস্থিত থাকে বাংলার নিজস্ব কথা । পালা পার্বণের ক্ষেত্রেও অবচেতনে কবি এড়িয়ে যান বাংলাকে। অথচ অনেক ভুলে যাওয়া ছবি কিভাবে যেন থেকে যায় অতীতের মতো স্মৃতি হয়ে, যে ছবি নগর সভ্যতায় হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ –

“শ্যাওলার মতো সন্ধে নামে তুলসীতলায়,
 মায়ের গলায় বাবার অসুখ,

না গাওয়া গান”... এ সবকিছু নিয়ে কবিকে বসে থাকতে হয় জীবনের অভিলাষে কারণ সৃষ্টির সাথে কোথাও বোধহয় অপেক্ষাও মিশে থাকে স্বভাবত –

“আমি একফালি ওম ধরে বসে আছি-
 এ উত্তাপ আমার একার।”

কবিকে মনে হয় অতীতচারী...সব কিছু ফিরে ফিরে আসে ... কখনো স্কুল জীবনের বন্ধু কিংবা কৈশোরের ইদিপাস  আসে স্বপ্নের মতো ‘আত্মহত্যার রাতে’ 

“পুজোর জামা আর পাউডার-ঘাড় ঘুরিয়ে
 বাবার সাথে তোমাকে হাঁটতে দেখে”
 মনে মনে ইদিপাস ইদিপাস খেলছি... ”

অনির্বাণের কবিতা সমকালীন হয়েও কোথায় যেন আবহমানের কথা বলে, জীবনযাপনের দীর্ঘ পরিক্রমার কথা বলে, সেটা বলে নিজস্ব ভঙ্গিতে কিন্তু তাতে মিশে থাকে সাবেকি কিছু ভাবনা, না ভুলতে পারা কিছু দৃশ্যকল্প । ভারতীয়  তত্ত্বকে অন্তত দৃশ্যে অস্বীকার করতে পারেন না কবি, কোথাও যেন সমকাল সামাজিকতা কিংবা রাজনীতি তাকে ঘিরে রাখে – 

“চেঁচিয়ে বলিনি,
বিপ্লবী, কর্মসূচি থেকে বিপ্লব সরালে কেন?
আর তুমি কিনা এখনই
হাত থেকে সিঁদুর ফেলে দিয়ে
থর থর করে কেঁপে উঠলে ...? ”

এখান থেকেই কবি সম্ভবত পান ঈশ্বরের ধারনা, যে ঈশ্বর ধুলোবালিময় পথে হাঁটতে বেরোন –
 “আমি ও ঈশ্বর জামা বদলাই
জীবন বদলাবার মতো,
স্নান সেরে
নিজেদের উদোম দেখে চমকে উঠি ।”

কবির  বোধহয় এটাই উপলব্ধি হয়, যে কোনও অজুহাতে অস্বীকার করার চেয়ে বিশ্বাসই বোধহয় উত্তীর্ণ করে মানবাত্মাকে
“তখন আর যুক্তি-টুক্তি কাজ করে না
শুধু
কোনো এক বোধ কাজ করে... ”

কবি ও ঈশ্বর খই ছড়িয়ে ফেরেন এবং লিখতে বসেন, শেষ পর্যন্ত কবি লিখে যান – কারণ সেটাই তার একমাত্র পরিত্রাণের
পথ – “ভাবি না, বিশেষ কিছুই আর ভাবি না,
লিখতে হয় লিখি । ”

যদিও কবির সংশয় ঘোচে না, নিজের ঢাক বাজানোর এই যুগে- দিনের পর দিন বছরের পর বছর ওয়েবজিনে কিংবা ছাপার অক্ষরে নিজের খরচে টিকে থাকার দুনিয়ায় আদৌ কি কোনও মূল্যায়ন হয় ! ভার্চুয়াল কিংবা নামী-আনামি সাহিত্যপত্র আর তাদের তৈরি করা গণ্ডায় গণ্ডায় কলমচির ভিড়ে কবিকে কখনো বলতে হয় - 
“কবি মানে কিছু অসুখী কথার মিছিল
অসুখী সবাই, তবু সকলেই কবি নয়”


কথাটা নতুন যদিও নয়, মহান কবিকে অনুসরণ করে লেখা ... তবু অনির্বাণের যে এই অপ্রিয় কথাটা লেখার সাহস আছে সেটাই বোধহয় আগামীর রসদ হয়ে উঠতে পারে । 

  সন্ত নিকোলাসের হাড়গোড়  / অনির্বাণ ভট্টাচার্য /  ধানসিড়ি ,  কলকাতা- ৭০০০৫০ 

যোগাযোগ  : ৮০১৭৪২১১৮৪




 

কাল ছিল ডাল খালি / পাতাউর জামান

 


কাল ছিল ডাল খালি: গ্রামীণ রাজনীতির আবছায়ায় নাগরিক মননের    বুনোট 



অদিতি ফাল্গুনী 



তরুণ লেখক পাতাউর জামানের ‘কাল ছিল ডাল খালি’ পোস্টে যখন ঢাকায় প্রথম হাতে পেলাম, প্রথম কয়েক পংক্তি পড়তে না পড়তে বুঝলাম লেখক আর কিছু না হোক গ্রাম খুব চেনেন। চেনেন নিজস্ব করতলের মত। যে বিষয় নিয়ে তিনি লিখতে নেমেছেন, তা’ এত বেশি চেনেন যে লেখার বিষয়ের সাথে অপরিচয়ের ঘাটতি ঢাকতে গিয়ে অধিকাংশ লেখকের মত অলঙ্কৃত শব্দ বিন্যাস, উপমার আতিশয্য কিছু তার লেখায় পাওয়া যায় না। সাদামাটা, নিরলঙ্কার এবং নিরাভরণ তাঁর গদ্য তুলট কাগজে কাঠকয়লার সামান্য কয়েকটি রেখায় আমাদের সামনে প্রকাশ করতে সক্ষম হয় পশ্চিম বাংলার গ্রাম বিশেষত: মুসলিম গ্রাম জীবন। এ আখ্যান গ্রন্থ নিরুচ্চার মমতায় ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে যে কোন সংখ্যালঘু জনপদের একান্ত যত দ্বিধা, সংশয় আর একদিকে সমাজের গরিষ্ঠ স্রোতের সাথে মিশতে চাওয়ার বাসনা এবং সে বাসনা পূরণে যত ভয় ও সন্দেহ জনিত হতাশা। জটিল এ মনস্তত্ব প্রায় ‘বিভূতিভূষণীয়’ সরলতায় উপস্থাপন করতে পেরেছেন এ তরুণ লেখক। ওপারের সংখ্যালঘু হিসেবে এ মনস্তত্ব আমার  খুব চেনা- চেনা গরিষ্ঠের প্রতি এ ভয়, সন্দেহ আর নিরাশার দোলাচল!পাতাউরের লেখা নিয়ে যত্ন করে লিখতে চাচ্ছিলাম বলে লিখতে অনেকটা দেরিও হয়ে গেল। তবে তাঁর লেখা নিয়ে লিখতে গেলে যত্নটা দরকার। 

১৯৪৭-এ দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম এবং বাংলাদেশে হিন্দুরা স্বাভাবিক ভাবে সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। সংখ্যালঘু মাত্রে নিজ অস্তিত্ব রক্ষা নিয়ে সদা চিন্তিত এবং শঙ্কিত। সে শঙ্কা এ আখ্যানগ্রন্থের শুরু থেকে খুব সহজ ভঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলেছেন পাতাউর। বাংলাদেশের হিন্দু যেমন, পশ্চিম বাংলার মুসলিমও তেমন। ক্রমাগত পিছু হঠা, পিছিয়ে পড়া জীবন। যে জীবনে সাতগাছিয়ার মোল্লাপাড়ার জামিলা আলমের সাথে পালিয়ে যাওয়ায় গ্রামের সম্পন্ন ভূস্বামী আকবর মোল্লার দলুজ (দহলিজ?) সালিশ সভায় বসে। জামিলার স্বামী বরকত স্ত্রীকে না একটি শাড়ি, না ভাল খাবার না জৈবিক চাহিদা মেটানো- কিচ্ছু করতে পারেনা। সালিশ সভার এক কোণায় বসা প্রেমিক আলম কাতর ভাবে জানান দেয়, ‘বিয়ে করব বলে পালিয়েছিলাম। পাক সারকাসের বস্তিতে ট্যাঙ্গারির কাজ করে ঠিক চলে যাচ্ছিলো। কিন্ত্ত এ শালা বরকতের বাচ্চা-’আলম বরকতের দিকে করুণামিশ্রিত চোখে কটমট করে তাকায়।তাকানোর ভঙ্গিটায় আর কিছু না হোক এই অর্থ বহন  করছিল যে তুই তো পারবিনা বরকত,দে না তিন তালাক বলে,দে না রেজাউল মাওলানার বিয়ে পড়ানো খাতা থেকে তোর সাদিনামাটা ছিড়ে, দে না মুক্তি জামিলাকে। দিব্যি দিয়ে বলছি এই গাঁয়ে থাকবো না। জামিলাকে নিয়ে পাকসারকাসে চলে যাব।ওখানে ট্যাঙারির কাজ করে  খাবো।
  বরকত কটমট করে চায় আলমের দিকে।

এভাবে খুব সংক্ষেপে একটা সালিশ দৃশ্যের মাধ্যমে পশ্চিম বাংলার মুসলিম গ্রামজীবনের ধারাবাহিক ছবি প্রতিষ্ঠা করতে থাকেন পাতাউর। তার আগে প্রথম দৃশ্যে তিনি এঁকে ফেলেছেন গ্রামের হিন্দু-মুসলিম চাষীদের সাধারণ লোক জীবনের একটি রিচ্যুয়াল ‘পান্তা চুরি।’ পান্তা চুরিটি কেমন রিচ্যুয়ালস্? লেখকের ভাষায়, ‘প্রথাটা কোন আদিম কাল থেকে চলে আসছে জানা নেই রহিমদের। দাদি প্রদাদিদের মুখ থেকে শুনে আসছে পান্তা চুরির কথা। জমিতে রোবার সময় পাশে পড়ে থাকা পান্তা যদি পাশের জন চুরি করে খায়, তবে যাদের পান্তা যারা চুরি করেখেয়েছে তাদের জমিতে রুয়ে দিতে হবে। আর যার জমিতে রোয়া হচ্ছে সে রাতে নেমতন্ন করে, মুরগি জবাই করে সবাইকে পেট ভরে খাওয়াবে। পরের রাতে খাওয়ানোর ভার পড়বে বিপক্ষের জমি মালিকের উপর।

সাবু নেমে ছিল পান্তা চুরিতে । কোমরের গামছা মাথার পাগড়ি হয়ে, তার সাথে ধানের শিস গুজে সবাই রাজা সেজেছিল। একদল যখন পান্তা চুরি করে গামলা টেনে আনছিলো, অপর দল হাঁকিয়ে ওঠে, এতক্ষণ বুঝতে পেরেছে পান্তা চুরির খেলা হচ্ছে
      হেই হেই চুরি করস ক্যানো ভাই
      জমি নাই,ধান নাই ওই টুকু মোদের ঠাই।
অপর দল দমকে দমকে এগিয়ে আসে -
      তা রাহখিস ক্যানো ভাই যখন রাখার সাধ্যি নাই
      পির আওলিয়া কয়েগেছে ছাড়তে হবে ভাই
ছন্দে দন্দে এক দল এগিয়ে আসে, ছন্দে দন্দে একদল পিছোয়। মাঠের সদ্য রোয়া ধানের শিষ গুলো রঙ্গ দেখে।’

পাতাউরের লেখনীতে পান্তা চুরির এ রিচ্যুয়ালের বিবরণ মনে করিয়ে দেয় চৈনিক লেখক লু স্যুনের লেখায় চাঁদনী রাতে চীনের কৃষক পরিবারের শিশু-কিশোরদের মটরশুঁটি চুরি করে খাওয়ার গল্প। তেম্নি সরস সহজতা। 

এ আখ্যানে প্রধান কয়েকটি চরিত্রের দু’জন হলো গ্রামীন অভিজাত আকবর মোল্লার শহরে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে আজাদ আর গ্রামের সাধারণ কৃষক যুবক সাবু। আর একটি প্রধান চরিত্র আজাদের দাদিমা বা পিতামহী।লেখকের হাল্কা কৌতুক মেশানো বয়ানে, ‘আকবর মোল্লার সাধ ছিল বংশে একজন সরকারি চাকরি করুক। আকবর মোল্লা,এই মাছ পাড়া শুদ্ধু  ক্যানো, এলাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধনী ব্যাক্তি। নিজস্ব দুখানা পুকুর, ঘেরি, বিঘে চল্লিশের উপর জমি,দোতলা বাড়ি। বাড়ির সামনেসান বাঁধানো পুকুর। মেয়ে নেই। আজাদ, এক ছেলে।দাদির সাধ ছিল নাতি ডাক্তার পড়ুক। মরার সময় নাতির হাতের ইনজেকশন নিয়ে সুস্থ হবে। কিন্তু সেই নাতি, উচ্চমাধ্যমিকে খারাপ রেজাল্ট করে  আর জয়েন্ট দিল না। কলকাতায় গেলো ইংরেজি নিয়ে পড়াশুন করতে। আকবরের ফ্যামিলিতে প্রথম বি.. অনার্স পড়তে যাওয়া কেউ।’

শহর থেকে এসেছে যে আজাদ তাকে নিয়ে গ্রামে জোর গুজব যে সে শহরে কোন হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করেছে। আজাদের মা অবধি আজাদকে নিয়ে চিন্তিত। ছেলে উদাস মুখে থাকে, বিড়ি খায় আর বাড়ির ল্যাণ্ড সেটে কে যেন ফোন করে। অন্য কেউ ধরলে কেটে দেয়। গ্রামের কিষাণ সাবুকে আজাদের মা অনুরোধ করেন তার ছেলেকে একটু সঙ্গ দিতে। 

আখ্যানের তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি নায়ক আজাদ পদ্মার বিলে যাচ্ছে।আজাদের অবস্থা এখানে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র শশী ডাক্তারের মত। গ্রামের অনেক মানুষের ভিড়ে সে নি:সঙ্গ। নগরায়ণ বা পশ্চিমা শিক্ষার আলোকায়ন তাকে বিচ্ছিন্ন করেছে তার স্বজনদের কাছ থেকে।স্বগোত্র থেকে এ বিচ্ছিন্নতা কত যে ভয়াবহ তা’ বোঝা যায় আখ্যানে পদ্মার বিল পাড়ে বেড়াতে গিয়ে সেখানে আজাদের প্রতি ছেলেবেলার বন্ধু রেজাউলের কিছু প্রশ্নে।

‘আজাদ রেজাউলের আগে আগে হাঁটে। সাবু পিছনে পিছনে।
-   তা কোলকাতায় ক্যামন আছিস? নামাজ টামাজ পড়িস তো? না হিঁদু হয়ে গেছিস!
আজাদ হাসে।
-   আমাদের গ্রামে তুই প্রথম সরকারি চাকরি করা ছেলে হবি। তাও মুসলমান। আচ্ছা কোলকাতার মুসলমানরা দাঁড়িয়ে না বসে ওটা করে? ওখানে শুনেছি সরকারি বাথরুম গুলোতে নাকি সব দাঁড়িয়ে মোতার জায়গা করা আছে। 
-   ধুর ছাড় তো ওসব।
আজাদ হাসে। মনটা বিষন্ন হয়। কি হবে এদের!’

আখ্যানের এ জায়গায় সংলাপের তীক্ষতা যে কোন সংবেদনশীল পাঠককে বিদ্ধ করবে। ভাবতে বাধ্য করবে একটি দেশের অত্যন্ত পিছিয়ে থাকা একটি জন-সম্প্রদায়ের মানসলোকের দিশাহারা তমসাচ্ছন্নতা সম্বন্ধে।

পদ্মার ঝিলের বিবরণও দারুণ এঁকেছেন লেখক। এককালে পদ্মার শাখা নদী দিয়ে চন্দ্রকেতু রাজা এসে বেড়াচাপা জয় করেছিলো। গোরাচাদের সাথে হেরে যাওয়ার দুঃখে সেই যে মজতে শুরু করেছিল, আজ সেই পদ্মা ঝিলে পরিণত হয়েছে। এক পারে মোল্লা পাড়া, আর এক পারে সদ্দারপাড়া। দূর থেকে দেখলে মনে হয় হিন্দুস্থান পাকিস্থান। এপারে মসজিদের আজান তো ওপারে মন্দিরের ঘণ্টার ধ্বনি। পাল্লা দিয়ে, পাল্লা করে উভয় উভয়কে উত্তর দেয়। ঠিক যেমন অবুঝরা করে। বুঝবে না জেনেও খুব বুজেছে বোঝার ভান করে।

যোগাযোগ বলতে জমির আল, তাও প্রত্যেক বছর চাষের সময় এক কোদাল করে কমে যাচ্ছে। ঐ আল দিয়ে ডিম ওয়ালা, ডাবওয়ালা, দুধ ওয়ালা, ফুলঝাড়ুর ফেরি, লওয়ালার কটকটি ভাজা দুই পাড়ের মধ্যে সংযোগ বজায় রাখে।

সরল, নিরাভরণ অথচ তীব্র আবেগময় গদ্যে পাতাউর আমাদের চেনাতে থাকেন পশ্চিম বাংলার মুসলিম গ্রামজীবন।কচি ধানের শিসের দুধ থেকে শুরু করে মোল্লাপাড়ার সামনের  ইসাকের চায়ের দোকানে তিন ঘন্টা ভিসিআরে সিনেমা দেখার জন্য দাম হিসেবে টিকিটের বদলে কমপক্ষে তিন কাপ চা ও তিনটে জবা বিস্কুট খাবার কঠোর নিয়মের বয়ান পাঠককে না হাসিয়ে পারেনা। মুসলিমপ্রধান সে গ্রামে টিভিতে সিনেমা শেষ হবার পর সংবাদে  ইরাকের উপর আমেরিকার বোমা আক্রমণ ও হতাহতের সংবাদ চিত্রে গ্র্রামের মানুষের ক্ষোভ দারুণ ভাবে ডিল করেছেন লেখক: শালা কাফেরের বাচ্চা। ক্যামন করে মোসলমান গুলোকে মেরতেছে দ্যাখ না।
যা না হুমদো মুখো, নিজেদের দেশের মাগিদের কাছে গিয়ে মর। ক্যানো আমাদের মুসলিম ভাইদের ধরে মেরতিচিস!’

 আখ্যানের পঞ্চম অধ্যায়ে ব্যক্তি আজাদের মানসিক টানা-পোড়েন পাঠকের জন্য বিশদ উপস্থাপনা করেন লেখক।এক দিকে ফেলে আসা শহরের নানা ঘটনা আর একদিকে গ্রামে স্বগোত্রের মানুষ। কারো সাথে যেন আজাদ নিজেকে মেলাতে পারে না।শহরের হিন্দু প্রেমিকা আল্পনা সাহার কথা ভাবে। ভাবে শহরে সে নিজে বা তার মত অন্য মফস্বলী বন্ধুদের শহরের তুখোড় বন্ধুদের হাতে ব্যবহৃত হবার কথা। আর এদিকে গ্রামীণ রাজনীতিতে আজাদের বাবার বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ তাঁর (আকবার মোল্লার) ছেলের (আজাদের) হিন্দু মেয়ে বিয়ের অভিযোগের গুজব ছড়ানো চলতে থাকে। এমন দ্বিবিধ সঙ্কটের ভেতর উদ্ধার হয়ে আসে আজাদের পিতামহী বা দাদিমা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকা এ বৃদ্ধা জীবনের ভুয়ো জ্ঞানে প্রজ্ঞাবতী। নাতিকে তিনি বোঝান: ‘বলছি গত ছয় বছর ধরে বাড়ির সাথে ঠিক কোন খানে সম্পর্ক ধরে রেখেছো শুনি! বছরে একবার বাড়িতে আস্তে। তাও জোর করে,ঠিক ঈদের আগের দিনে। পরের পরের দিন আবার চলে যেতে। ছবছরে,  আমার কথা ছেড়ে দাও, আমি বুড়ো হাবড়া মানুষ, ছেলের কোন দায়িত্বটা পালন করেছো? বা গ্রামের প্রতি? আজ গ্রামের ঐ মোটা বুদ্ধি মানুষ, তোমার মতে, গাছ পালা, পরিবার তোমাকে আপন করে নেবে ভাবলে কি করে।’

আজাদের প্রেমিকার অন্তিমে প্রেমের চূড়ান্ত পরিণতি দিতে অনাগ্রহের বেদনাও আজাদকে শান্ত ভাবে মেনে নেবার ধীরতা দান করেন প্রজ্ঞাময়ী পিতামহী। আখ্যানের অন্তিমে নায়ক তাঁর গোটা জীবনাভিজ্ঞতার বেদনাকে শান্ত ভাবে গ্রহণে সক্ষম হন এ পিতামহীর উপদেশে।

আগাগোড়া সুলিখিত এ আখ্যান যেন শুরু থেকে বিকশিত হবার একটা বিন্দু অবধি গিয়ে সহসা শেষ হয়ে যায়। লেখক যেন স্থির নিশ্চিত হতে পারেন নি এটি গল্প আকারে রেখে দিবেন না উপন্যাস হিসেবে শেষ করবেন! গ্রামীণ রাজনীতি বা আজাদ চরিত্রের আরো নানা বাঁক দেখানো যেত। যাহোক, যতটুকু করেছেন পাতাউর জামান, সেটা বা কম কি? তাঁকে স্বাগত।


       কাল ছিল ডাল খালি / পাতাউর জামান / নতুন শতক প্রকাশনী , কলকাতা-৭০০০২৯    যোগাযোগঃ ৯৮৩০৯০৭৭৯২ / ৯৮৩৬৩৫৬৩২০



ঋতুকাহন / বৈদূর্য্য সরকার


কবিতার অনন্ত ঋতু



সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়



“ গতকালের কথা আজ কত দূরের যেন ,

  সঞ্চয় বলতে কিছু শব্দ, মুহূর্তের সুরে

  বৃষ্টি ভেজার মতো ক্রমশ সিক্ত হয়ে, নরম হয়ে

  বেঁচে থাকা তোর উদাসীনতায়

  তুই ফোন ধরিসনি , আমাকে রিজেকট লিস্টে পাঠিয়ে...”

  (সুগন্ধ স্মৃতি)

সত্যিই আমাদের গতকালের কথাগুলো, না-ধরা ফোনকল, আরও কট ছোটখাট কথা আর কান্নার রেশ এভাবেই একদিন ঝাপসা হতে হতে মিলিয়ে যায়...মিলিয়ে কি যায় , নাকি কোথাও জেগে থাকে দিকনির্দেশহীন জোনাকির মতো? হয়ত সারা জীবন, এই আয়ুষ্কাল জুড়ে পড়ে থাকে কোথাও, পেরিয়ে যায় ঋতুর বদল...তবু যেন ছায়াপথে রয়ে যায় হারানো সম্পর্কের চিঠি , আমরা সেই চিঠি মাঝে মাঝে খুলে পড়ি, আবার বন্ধ করে দি , অথবা তা নিয়ে লিখে ফেলি দু-চার কলম। যেমন লিখেছেন কবি বৈদূর্য্য সরকার, তার ২০১৫ সালে প্রকাশিত ‘ঋতুকাহন’ বইটিতে । বইয়ের সমস্ত কবিতা সেই হারিয়ে ফেলা প্রেমিকার জন্যে লেখা যাকে আর কোনদিন ছোঁয়া যাবেনা, যাকে বলা যাবেনা- ‘আমার বিচ্ছিরি নিরুত্তাপ বেঁচে থাকায় / ভীষণ আনপ্রেডিকটেবল তুই ঢুকে পড়িস...’ , যার সুগন্ধি স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়াবে সর্বক্ষণ তবু যাকে নিয়ে শহর থেকে শহরতলি, শালবন থেকে উত্তরবঙ্গের চা-বাগান আর যাওয়া হয়ে উঠবেনা কোনও বর্ষার মেঘময় দিনে কিংবা গেরুয়া রঙের চৈত্রের গোধূলিতে। এই হারানোর নীল রুমাল উড়ে আসে  বৈদূর্য্য -এর কবিতায়, এবং বাংলা প্রেমের কবিতার প্রচলিত ধারা না মেনেও নিজস্ব ভঙ্গিমায় নিজের কবিতা লিখতে তিনি সফল।

“ হাতচারেক দূর থেকে ওয়েস্ট বক্সে ছুঁড়ে দিচ্ছিস আমাকে,
  চিররহস্যে ঢাকা দ্বীপে নড়বড়ে সাঁকো পেরোতে পারিনি বলে
  অন্যপারে চলে গেছিস তুই হাত ছেড়ে, বালিকার কৌতূহলে...”
  (বাতিল গল্প)

ওপরে উদ্ধৃত কবিতাটির আর্তি হৃদয় ছুঁয়ে যায়, নাড়িয়ে যায় মন...আমরা যারা ভালোবেসেও সাঁকো পেরোতে পারিনি, ফলে চলে গেছি অনিবার্য ওয়েস্ট পেপার বাক্সে, যারা এখনো দেখতে পাই অন্যপারে মিলিয়ে যাচ্ছে ছায়া, তাদের সবার কথা বলে যায় এই কবিতা। দুটো নদী মিলতে পারে, কিন্তু দুটো মানুষ পারেনা, একা পড়ে থাকে চিররহস্যে ঢাকা দ্বীপে – মেরুন দুঃখের এই জীবন নিয়েই আমাদের পথ হাঁটা, চলাচল। ‘বালিকার কৌতূহল’ – এই ব্যবহার ভাবায়, প্রেমিকের মেয়েটির প্রতি তীব্র ভালবাসাময় অভিমান গাঁথা এই দুটি শব্দে। এ ভাবেই, শব্দ থেকে শব্দে, অক্ষর থেকে অক্ষরে , পঙক্তি থেকে পঙক্তি , হেমন্ত থেকে শীত, বৈশাখ থেকে চৈত্র, বসন্তের রাধাচূড়া-পথ থেকে শহুরে শরতের আগমনীবার্তা – হাল্কা মেঘের মত ভেসে বেড়ায় ‘ঋতুকাহন’ ।

বৈদূর্য্য -এর কবিতার ভাষা তার নিজস্ব, এবং তা আশা জাগায় কারন ‘ভালো’ কবিতা বাংলায় অনেক লেখা হয়ে গেছে, আরো হবে, কিন্তু সিগনেচার খুব জরুরি। খুব ছন্দ মেনে তিনি লেখেননি , তবে কবিতার অর্ন্তলীন যে ছন্দ তা তাঁর কবিতায় খোলা হাওয়ার মত বয়ে গেছে। ব্রায়ান অ্যাডামস লিখেছিলেন –“Let’s make a night to remember...January to December...”; বৈদূর্য্য  সরকারও তাঁর ‘ঋতুকাহন’ গ্রন্থে এঁকেছেন এক ঋতু পেরিয়ে হেঁটে চলা প্রেমের অনন্ত ছবি যা কোনো সময়রেখা মানেনি। তবে, আগামী দিনে, প্রেমের নস্টালজিয়ার বাইরে বেরিয়ে কবিতার অনন্ত ভুবন ছোঁয়ার চেষ্টা তিনি করবেন, এই আশা রাখি।


ঋতুকাহন , বৈদূর্য্য সরকার , অশোকগাথা প্রকাশন , উত্তর ২৪ পরগনা-৭৮৩২২২

যোগাযোগ : ৮০০১৩০৫৬০২

হ্যাঁ কিংবা না / মৃন্ময় ভৌমিক



হ্যাঁ কিংবা না, তাতে আসে যায়!


সায়ন্তনী নাগ



জীবন কিছু ধনাত্মক ঋণাত্মক অনুভূতির সমাহার...তার কোনটা আশাব্যাঞ্জক আর কোনটা নিরাশার, অনেক সময়েই গুলিয়ে যায়, কারণ হ্যাঁ আর না মাঝে মাঝেই ওভারল্যাপ করে থাকে এ ওকে। মৃন্ময় ভৌমিকের কবিতার বই ‘হ্যাঁ কিংবা না’ পড়তে গিয়ে সেটাই মনে হলো। যদিও কবি তার নিজস্ব কিছু ভাবনা থেকে হ্যাঁ আর না – এই দুই ভাগে ভাগ করেছেন কবিতাগুলোকে, কিন্তু পাঠকের কাছে তাদের মূল সুরটি এক...জীবন, যে জীবন ছড়িয়ে আছে শহরের উন্নয়ন নামের ভেপার ল্যাম্পে, শেষ ট্রামে, হেলমেটহীন বাইকে, ফ্লাইওভারে, দেওয়ালে লটকানো পুরোনো ক্যালেন্ডারে, প্রেমে ও অপ্রেমে। সে জীবনই লিখিয়ে নেয়

‘উত্তাল ঢেউ আর ঘূর্ণির মাঝখানে

তুমি যাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছো

সে আসলে জল ছাড়া আর কেউ নয়।’



এ হয়তো আমাদের অজানা নয়। তবু আমরা আঁকড়ে ধরতে চাই সেই খড়কুটো। ‘জ্যাম-ঝঞ্ঝাট-চেনা কোলাহল’ –এ অপেক্ষার পল গুণতে গুণতে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলি মৃন্ময়ের ঝকঝকে নাগরিক উচ্চারণ, যা ভীষণভাবে একালের, ভীষণভাবে তরুণ। আধুনিক সময়কে কবি চিনেছেন কেবল ‘লোকাল ট্রেনে অফিস ফেরত ক্লান্ত জুতোগুলোর দিকে তাকিয়ে’ বা ‘পেটের মধ্যে সাহসী পেট্রোল’ ভরে’ ছোটা বাহনে নয়। তিনি টের পেয়েছেন
‘রাতের কোনো ডিম্যান্ড নেই
বাড়তে থাকে দিনের বাজারদর
তোমার হাতে গুগলটকের প্রেম
আমার হাত কবিতা নির্ভর’

কবিতা নির্ভর হাতটুকু আছে বলেই এড়িয়ে যাওয়া যায় ব্যকরণগত ত্রুটী, ছন্দের বিচ্যূতি, অগ্রাহ্য করা যায় শব্দের প্রয়োগগত সীমাবদ্ধতা। সংক্ষিপ্ত কবিতার মধ্যেও দু-এক লাইনের চমক দেওয়ার প্রবণতা নজরে আসে, কিন্তু তার আপাত চাকচিক্যতার আড়ালে যে বোধ আছে, তাকে শুধু কবির নিজস্ব বিশ্বাসজাত আপ্তবাক্য বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর তাই তা পাঠকের কাছে সহজে পৌঁছয়। পড়ে ভালো লাগে
‘কয়েকটা দিন বেঁচেবর্তে থাকার
সব সুযোগই কালচে ফিতেয় বাঁধা’

একটি দীর্ঘ কবিতা (‘ফুলশয্যা’) ছাড়া আর প্রায় সবকটিতেই মৃন্ময় মিতবাক। বিশ্বাস করেছেন সংক্ষিপ্ততাই সৌন্দর্য। বন্ধ কারখানাকে ‘চুল দাড়িওয়ালা রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মানুষ’ মনে হয়, যে কবির তার আর শব্দ বাহুল্য কি প্রয়োজন! দু একটি কবিতায় হঠাৎ কিছু প্রাচীণতার গন্ধ লাগে (যেমন ‘বর্ষাবরণ’)। কবি যখন নিজেও বোঝেন ‘...অনেক কথা/ আমাদের ভেতরে খুচরো পয়সার মত জমা হয়/ তারপর একদিন মানে কোনো একদিন/ ঐ পয়সার আর চল থাকে না...’ ফলে অচল শব্দ বা ভাব ব্যবহারে আরেকটু সতর্কতা দরকার।

ছোট এবং প্রায় মুদ্রণ ত্রুটিহীন বইটিতে কোনো কবি পরিচিতি নেই, ফলে জানতে পারি না, এটি কবির প্রথম বই কিনা। তবু তিনি এই দশকের কবি আন্দাজ করে নিয়েই আশান্বিত হই, ভবিষ্যতে প্রয়োগগত বিচ্যূতি শুধরে তিনি আরো নতুন উচ্চারণে মুগ্ধ করবেন। বন্ধুর সাথে কথা হয়নি বলে যে কবি মৃত্যুর দিন একটু পিছিয়ে দিতে পারেন (‘বন্ধু’) তাঁর কাছে এটুকু দাবী রাখাই যায়।


হ্যাঁ কিংবা না / মৃন্ময় ভৌমিক / পত্রলেখা

যোগাযোগ : ৯৪৩৪৩৪২৫৫৩

উইন্ডো সিট থেকে / সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়



উইন্ডো সিট থেকে : ব্যাপ্ত পৃথিবীময় কবিতা


যশোধরা রায়চৌধুরী


জীবন বেয়ে উঠতে গিয়ে টের পাই,
কী তুমুল নীচে নামাচ্ছে জীবন...তালা  খুলে ঘরে ঢুকে দেখি
নিভন্ত সোফার পাশে আমাদের ছায়া বসে আছে।
...
শনিবারগুলো রবিবারে গড়িয়ে গিয়ে
সোমবারের ভেতর ঢুকে  পড়ে
অজানা বিপন্নতার মতো 
(পুরনো হাসির শব্দ)

আপাত সরল একটা বয়ান। কথাগুলো আলাদা করে দেখলে প্রতিটাই কতগুলো আলাদা আলাদা ছবি। অথচ সবটা একসঙ্গে যখন আসছে, তোইরি হচ্ছে একটা ট্যারচা , উল্টোপাল্টা, অদ্ভুত ছায়ার শব্দজাল। যার ভেতরে চিনে নিতে থাকি আমার চেনা পৃথিবীকেই। আরো স্পষ্ট করে। সেই পৃথিবী যেহেতু ভুবনায়িত, ও উন্মাদ, তাকে ধরতে শব্দগোলকটিও ততোধিক ব্যকরণহীন। হয়ত বা, অধুনান্তিক, যাকে সাদা বাংলায় বলে পোস্ট মডার্ন।

খায় না মাথায় মাখে এই পোস্ট মডার্ন?

বরং সহজ করে বলা যাক। ভাবা যাক।  একজন কবি একবার বলেছিলেন, আমি গদ্য লিখি সর্বসাধারণের জন্য, প্রবন্ধ লিখি পন্ডিতদের জন্য, আর কবিতা লিখি নিজের জন্য।

এই কথা বলবার সঙ্গে সঙ্গে সেই বিখ্যাত ইউরোপিয় লেখক, একটা আলাদা তাক তৈরি করলেন কবিতার জন্য। আর, মজার কথা হল, এই কবিতাই এমন এক পণ্য যার বাজারমূল্য হ্রাস পায় ততটাই, যতটাই কবি হয়ে ওঠেন আত্মগত। কবির নিজের জন্য লেখা যত বেড়ে চলে, পাঠকপ্রিয়তা ব্যস্তানুপাতিকভাবে হ্রাস পায় ।

পাঠকপ্রিয় কবিতাকে “তত ভাল কবিতা নয়” বলবার যে প্রচলন, তা কিন্তু বহু যুগ ধরে নয়। এরও এক ইতিহাস আছে। রচিত ইতিহাস না হলেও। অন্যদিকে ফেবল, ব্যালাড, পাঁচালি, কথা, গান, এসবের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত জনপ্রিয়তম কবিতাও “কবিতা নয়” এমন তো নয়।

তবু, বিগত দুই শতকের পাঠ অভিজ্ঞতা থেকে, আমরা পেয়েছি, শিল্পের সবচেয়ে উৎকর্ষের জায়গা কবিতাকে দেবার একটা আলাদা বোধ। আর সম্ভবত এই বোধের ছিটেফোঁটাকে সম্বল করেই আজকের দিনে লিখতে শুরু করেন কোন কবি।

যখন নিজের জন্য লেখে কবি, তখন তার কাছে অন্যরা, পাঠকরা, আসে পরের স্তরে। নিজের টার্মসে খেলেন কবি, তাঁর কাছে অন্য কোন হিসেব নেই তখন। যে পড়বে তার দায় কবির লিখিত হেঁয়ালি অথবা গোপন লিপিচিত্রকে ডেসাইফার করার। যেভাবে গোয়েন্দা পড়েন গুপ্ত লিপি, সেভাবে আমরা পড়ি কবিকে, তখন। আর পড়তে পড়তে দেখি আমাদের পাঠ নিজেদের রাস্তা করে নিচ্ছে।

সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়র বই ‘উইন্ডো সিট থেকে’। তৃতীয় মৌলিক বই ।

গভীরতায় এক বই থেকে অন্য বইতে একধরণের প্রগতি আশা করা আমাদের অতিপুরাতন ব্যাধি। যদিও ব্যাপ্তির দিক থেকে সৌভিক চিরকালই অনেকটা আশা জাগায়।  অন্তত প্রথম বই থেকে প্রতিটি বইই পড়ার আমার অভিজ্ঞতা থাকায় বলতেই পারি, যে, তার কোন খামতি নেই নিজেকে অনেক দূর অব্দি টেনে নিয়ে যাওয়ায়। এ ক্ষেত্রে শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় বা তারাপদ রায়, পঞ্চাশ দশকের এই দুই দুরন্ত, অনাবিল, অতি ব্যাপ্ত আকাশের কবির কথাই মনে পড়ে, তুলনায়। বিষয়ের বৈচিত্রে ও আপাত সরল চলনে পৃথিবীকে এক লপ্তে ধরে নিতে পারার এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রয়াস সৌভিকেরও।

এক অর্থে এই তৃতীয় বইতে তার সঙ্গেই সে অধিকার করেছে এক বিষণ্ণতার স্বর, এক ধরণের অ্যাংস্ট। এই বয়োধর্মটি হয়ত প্রার্থিতই ছিল।
যেমন পম্পেই কবিতাটিঃ

লুম্পেন শহর থেকে
মেঘলা কলেজ স্ট্রিটে
চিরকুট ছুড়ে দিল কেউ।

মৃত মানুষের মিছিল এখানে,
ধূসর চায়ের দোকান,
ভুটানি সোয়েটার কেউ কেনে না এখন, ওয়েলিংটনে।

এই বিষাদ ব্যক্তিবিষাদ ও শহরবিষাদও বটে। নস্টালজিয়া ও এগিয়ে চলার টানাপোড়েন আগেও দেখেছি সৌভিকের কবিতায় তবু এতে আরো বেশি বেশি করে সিপিয়া রঙ আসছে।

“জটিল অঙ্কের মতো মেঘ
ঢেকে দেয় কলকাতা স্কাইলাইন
ভাসমান দু-একটা চিল
তড়িঘড়ি ফিরতে চায় ঘরে।
সেপিয়া আকাশ জুড়ে ফুটে ওঠে
কাঁপা কাঁপা জলছবি – বৃষ্টিতে ভেজার সময়
হঠাৎ আটকে পড়া গ্লোব সিনেমায়। ...“ 
(উইন্ডো সিট থেকে)

ভাষায় একাধিক কাজ করেন তিনি। প্রথমত হিন্দি ইংরিজি বাংলা সব বুলি একসঙ্গে মথিত হয় তাঁর কবিতায়। এই ভাষা মিশ্রণ, আমরা জানি, আজকের প্রতিটি দিনের অবক্ষয়।  অথচ, কবিতায় এই ধরনের পরীক্ষামূলক ভাষামিশ্রণ কবিতাকে দেয় এক ঋদ্ধ বয়ন।

যখন  বলছি যে কবি শুধুই ভাষা নিয়ে থাকবেন, তাকাবেন না বাইরের দিকে, তখনও কি ঠিক বলছি? বাইরের পৃথিবী কি ভাষার আর শব্দের মধ্য দিয়েই লাট খেয়ে এসে পড়ছে না আমাদের মস্তিষ্কে? তাকে ঠেকিয়ে রাখবেন কেন কবি? তাকে বর্ণনাও করবেন না তিনি। শুধু তার থেকে ছবি তুলে নিয়ে নিয়ে এক দ্বিতীয় পৃথিবী তৈরি করবেন।

মৃত বাড়ি, বড় ঘুম, ফুল পাঞ্জাব লরি, ট্যাক্সিওয়ালা, মিসেস চ্যাটার্জি, হর্ষিতা অরোরা অথবা ভিজিটিং আওয়ার্স...  সৌভিকের কবিতার ভেতরে  সমস্ত পৃথিবী ঘুর্নি খেয়ে এসে পড়ে । এই উপাদান এসে পড়াটা খুব লক্ষ্য করে দেখার মত। কেননা, “আত্মকেন্দ্রিক” বলতে যা বোঝায় তা কিন্তু এই কবিতাগুলি আদৌ নয়। কিন্তু সমাজ সচেতনতা, সমাজবাস্তবতা ইত্যাদি ইত্যাদির কোন মহান মোহ তাঁর শব্দচয়নে কাজ করেনা। তাঁর শব্দচয়ন মূলত শব্দসংস্রব, শব্দসহবাস, শব্দদের নিয়ে তুমুল খেলাধুলো।

এই সব কবিতায় অতিরিক্ত বিষয় নিয়ে সন্দিগ্ধ যে পাঠক, কবিতার ভেতরে কবিতা খুঁজতে থাকা পাঠক, তাঁদের প্রত্যেকের মধ্যে তার বাঁধা হয়, যোগাযোগ ঘটে। কবিতাকে আলাদা করে দেখতে চাওয়া পাঠক, আবার কবিতা নামক একটি বস্তুর অবয়বও দেখতে পান যেন। ঝাপসা আদলে।

তবে এই বইতে যে মাত্রাবৃত্তের অতি কতিপয় কবিতা আছে, সেগুলি অন্যরকমের, হয়ত সৌভিকের এই ক্ষেত্রেও ক্ষমতাটি তিনি দেখিয়েছেন সফলভাবে। কিন্তু তাঁর আসল এলাকা গদ্যধর্মী কবিতাই। শ্রেষ্ঠ উদাহরণ বোধ হয় “চাবুক” আর “সেফটিপিন”।

পাঠকের পড়ার জন্য এই বই রইল। খুলে খুলে পড়ার আর মজে যাওয়ার জন্য । 



                  উইন্ডো সিট থেকে  /  সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় / ধানসিড়ি