গত ১২ বছর ধরে
নিউটাউনের বাসই দিনের ২৪ ঘন্টার মধ্যে চার ঘন্টা দখল করে নিয়েছে বিকাশ সামন্তের। সকালে বাজারের থলি নিয়ে বাজার করা বা সন্ধ্যেতে বউকে সঙ্গ দেওয়ার
তাগিদে সংসারের গল্প করা; এই রুটিনেই জীবন চলছিল বিকাশের। তবে বিকাশ এটুকু জানে, জীবনটাকে দাবিহীন করার চেয়ে সুখ আর
কিছুতে নেই। তাই এতকিছু ভাবারও সময় নেই জীবনে। চাকরীতে ঢোকার পর প্রথম প্রথম
অস্বস্তিতে পড়লেও ধীরে ধীরে বুঝেছে চোখ কান বুজে চলাটাও কখনো কখনো অনেক সমস্যার
হাত থেকে টেনে তুলতে পারে আমাদের। অফিসে তাই খুব বেশি কারোর সাতেপাচে থাকে না
বিকাশ। নয়তো অনিল দত্তের দিনের পর দিন লীনার মতো অল্পবয়সী মেয়েদের
সাথে গা জোয়ারী বা বুচুবাবুর নানা অজুহাত দিয়ে কাজ ফাঁকি দেওয়ার বিরুদ্ধে আওয়াজ
তুলতেই পারে অভিতাভ চ্যাটার্জীর টেবিলে। কিন্তু এই বয়সে এত ঝামেলা পোষায় না
বিকাশের। জীবনের এই পর্যায়ে এসে নামের থেকেও শান্তিটা বেশি প্রয়োজন। এইসব হাজারটা
চিন্তা বিকাশের মাথার মধ্যে পাক খাচ্ছিল ঠিক এমন সময় কনুই এর গুঁতোটা সোজা নাকে এসে
লাগার পর আচমকাই গলা দিয়ে প্রতিবাদটা বেরিয়ে এসেছিল বিকাশের। হঠাৎ করেই মেজাজটা চড়ে গেছিল। ভীড় বাসে ওর ঠিক সামনে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা লাল চুলের ছেলেটাকে
বলেছিল, “হ্যাঁ ভাই,
বুড়ো মানুষটাকে মেরেই ফেলো। দুদিন পরে তো মরতেই হবে।”
“আহ কাকু! চিৎকার করছেন কেনো বলুন তো? স্যরি বললাম তো। দেখছেন
না ভীড় বাস। আর আমি
সামনের স্টপেজেই নেমে যাব।” রীতিমতো চিবিয়ে চিবিয়ে বলল কথাগুলো ছেলেটা। কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় বাসটা থামতেই ছেলেটা নেমে গেল। মুখের কথা মুখেই থেকে গেল। নিজেকে সামলে নিল বিকাশ। এতদিন এই রূটে যাতায়াত করতে করতে এটুকু বুঝেছে এখনকার ছেলেমেয়েরা
আগের চেয়ে অনেক বেশি উগ্র। এদের সাথে
এঁটে ওঠাও যথেষ্ট কঠিন কাজ। তাই চুপ
করে থাকল এবারও। মেজাকটা
তেঁতো করার কোনো মানে হয় না এই সময়। পরের স্টপেজ আসতেই রোগা, আইফেল টাওয়ারের মতো লম্বা কন্ডাক্টর নতুন প্যাসেঞ্জার তুলে বাসের
গায়ে কিল, চড় মারতেই বাস আবার চলতে শুরু করল। এবার কয়েকজন প্যাসেঞ্জার নেমে যাওয়ায় সিটে বসতে না পারলেও হেলান
দিয়ে দাঁড়াতে পারল। পিঠটার
একটু স্বস্তি আপাতত। এমন সময়
বিকাশের খেয়াল হল ওর পাশের সিটে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে বসেছে। দুজনের বয়সই কুড়ির আশেপাশে। কিন্তু এদের দেখে বিকাশ বুঝতে পারল না এরা প্রেমিক-প্রেমিকা নাকি ভাই-বোন। তাই ওদিক থেকে চোখ সরিয়ে ঘড়ি দেখল। নাহ বাসটা ভালোই যাচ্ছে। ঠিক সময়েই পৌঁছে যাবে।
পরের স্টপেজ আসতেই আবার লোকজন নামতে শুরু করল। সামনের দিকটা ফাঁকা হল কিছুটা। কিন্তু সিট ফাঁকা না হওয়ায় বিকাশ আগের মতোই দাঁড়িয়ে থাকল। এতক্ষণ পর পাশের ছেলে-মেয়েদুটোর কথা শুনতে পেল। মেয়েটা চাপা গলায় বলতে লাগল, “আপনি কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে আমাকে বিরক্ত করে চলেছেন। আপনি জানেন না এর ফল কি হতে পারে!”
স্পষ্ট শুনতে পেল কথাগুলো বিকাশ। কথাগুলো প্রায় ফিসফিস হলেও একদমই পাশে থাকার সুবাদে কানে প্রতিটা
কথাই পৌছাল। এতক্ষণ
সেভাবে কান না দিলেও এবার একটু কৌতুহল হল। তাই চুপচাপ ওদের কথা শুনতে লাগল।
“আপনি কি জানেন এই ভীড় বাসে আপনার কি হাল করতে পারি?”, মেয়েটা বলে চলল।
এবার বিকাশের একটু সন্দেহ হল। তবে কি ছেলেটা অপরিচিত একটা মেয়ের সাথে খারাপ কিছু করতে চলেছে? নয়ত মেয়েটা এমন কথা বলছে কেন? আর সবচেয়ে সন্দেহজনক ছেলেটার ব্যবহার। মেয়েটা এত কিছু বলা সত্ত্বেও চুপ করে আছে কেন? নিজের পিঠ বাঁচানোর জন্য নাকি পাবলিকের ভয়ে? বেশি চেঁচামেচি না করে সময় মতো কেটে পড়ার তালে আছে মনে হচ্ছে। জানুয়ারীর এই ঠান্ডাতেও বিকাশ উত্তেজনায় ঘামতে লাগল। পকেট থেকে রুমাল’টা বের করে কপালের ঘাম মুছে নিল। কি করবে ও এখন? একজন সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে কি করা উচিত ওর? কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই আড়ি পাতল ওদের কথাতে। এবার শুনতে পেল, “এতবার বারণ সত্ত্বেও আপনি ফোন করে চলেছেন গত দুদিন ধরে! কেন? আপনি বাংলা ভাষা বোঝেন না? আর হ্যাঁ, আমাকে আর পাঁচটা মেয়ের মতো ভাববেন না। আর সেটা যদি ভেবে থাকেন সেটা আপনার...”
নাহ আর শুনতে পারল না বিকাশ। এতকিছুর পর পুরো ঘটনাটা ওর সামনে জলের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু কি করবে এখন? একটু আগেই যা হল ওর সাথে!! নাক’টা হয়ত ফুলে লাল হয়ে আছে এখনো। সবাই যে ভাবে বসে বসে মজা দেখছিল!! অমন একটা হেনস্থা হল অথচ কেউ মুখ দিয়ে একটা আওয়াজ পর্যন্ত বের করল না। ইচ্ছা করছিল সব কটার মাথায় একটা করে রাম গাঁট্টা দিয়ে আসতে। এদিকে সাহসেও কুলোচ্ছে না একা কিছু করার। কি যে করবে সেটাই মাথায় আসল না বিকাশের। বয়স যে খুব বেশি হয়েছে তাও নয়। সকাল সকাল গুঁতো খেয়ে মাথার বুদ্ধিগুলোও ভোঁতা হয়ে গেল নাকি!!
এই এই!! কি হচ্ছে এটা!! আমার হাত ধরেছেন কেন আপনি?
বিকাশের মনে পড়ল ক’দিন আগে পেপারে এমন একটা খবর পড়ছিল। অপরিচিত মেয়েদের নিয়ে গিয়ে বর্ডারে চালান বা বেশ্যাবৃত্তির জন্য নিলাম করে দিচ্ছে। একটা বড় চক্রের খোঁজ পেয়েছিল পুলিশ। এমন আরও চক্র থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এরা সাধারণত শহরের প্রতিটা আনাচেকানাচে নিজেদের নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে রাখে। সবচেয়ে বড় বিষয় হল, এরা সবাই শিক্ষিত এবং স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। পোশাক-আশাক, চালচলন দেখে কেউ সন্দেহও করতে পারবে না সহজে। এই বাবাজীও হয়ত ওদেরই একজন, সাধারন মানুষের ভীড়ে মিশে নিজের কাজ করে চলেছে। দেখে ভদ্রবাড়ির মনে হলেও এরা ভেতরে ভেতরে এত শয়তান!! না জানি আরও কত ক্রিমিনাল রেকর্ড রয়েছে এর নামে। তাছাড়া বাসসুদ্ধ লোকের সামনে হাতে নাতে ধরতে পারলে ওদের’কেও একটা জবাব দেওয়া যাবে। এতদিনের চাকরীজীবনে এমন অপমান কখনও হয়নি ওর। নূন্যতম সৌজন্যবোধ টুকুও নেই মানুষগুলোর। এখনকার ছেলেমেয়েদের অধঃপতনটা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে সেটা আর একবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো যাবে। কিন্তু একা তো সম্ভব নয় সেটা। অথচ চোখের সামনে এমন একটা কান্ড ঘটতে দেওয়াও যায় না। একটু ইতস্তত করে সামনের লোকটাকে সবে গায়ে হাত দিয়ে ডাকবে, এমন সময় ছেলেটার গলা প্রথম শুনতে পেল বিকাশ,
“তা ম্যাডাম শেষ হল আপনার নাটক?”
শান্ত অথচ মোলায়েম গলা শুনে বিকাশ ওদের দিকে তাকাতেই চক্ষু ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়। মেয়েটার মাথা ততক্ষণে ছেলেটার বুকে চলে গেছে। মেয়েটা ছেলেটার আঙ্গুলগুলো নিয়ে খেলতে খেলতে বলতে লাগল, “হুহ! নাটক তাই না! বাসসুদ্ধ লোকের মাঝে ধোলাই দেওয়া দরকার তোমাকে। মেয়েটা কে ছিল?”
কেউ ছিল না পাগলী। আমি তো শুধু তোমাকেই...
“হ্যাঁ জানি।”, ছেলেটাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে জড়িয়ে ধরল মেয়েটা।
বিকাশের ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া অবস্থাটা কাটল ড্রাইভারের আচমকা ব্রেকে কপালে সজোরে ঠোকা খাওয়ায়। অন্যমনস্ক থাকায় সামলাতে পারল না নিজেকে। মুখটা তেঁতো হয়ে গেল যেন। জীবনটাই শালা এরকম। একটু অসাবধান হয়েছও তো ক্লিন বোল্ড। ফিরে আসার কোনো চান্সই থাকে না।
ছেলে-মেয়ে দুটো মনে হয় ওদের গন্তব্যে পৌঁছে গেছিল, তাই সিট ছেড়ে উঠে পড়ল। বিকাশ ওদের পাশেই হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ। ওকে দেখে ছেলেটা হেসে বলল, “আঙ্কেল বসুন আপনি। আমরা নেমে যাব।”
বিকাশের মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোলো না। পুরো ব্যাপারটা হজম করার চেষ্টা করল। চুপচাপ সিটে বসে ওদের হাত ধরে চলে যাওয়া দেখতে দেখতে ভাবতে লাগল, ‘মেয়েটির পরিকল্পনা মত গণধোলাই’টা শেষ পর্যন্ত কার হল? প্রেমিকের নাকি বিকাশের সন্দেহবাতিকতার?’
জানালায় শহরের দৃশ্য বদলাতে শুরু করল আবার।
No comments:
Post a Comment