Friday, May 11, 2018

গল্প ২ : বৃত্ত : সুমন দত্ত




     

                                          



মাকে লোকে পাগল বলে। ভাবলেই আমার হাসি পায় পেট ও সমাজের দায়ে আমি রাস্তায় পাগল হয়ে ঘোরাফেরা করি

          ধান্দা ছাড়া এই দুনিয়া চলে না একটা সময় বস্তিতে থাকতাম বাবা হেদোর ধারে কাগজ বিক্রী করত আর মা কি করত ঠিক জানা ছিল না বাবা বেড়িয়ে গেলেই মা রান্না সেরে সেজেগুজে বেড়িয়ে পড়ত আমাকে ঘরে একা রেখে আমি নিজের মতন খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়তাম খাওয়া আর ঘুম এই ছিল তখন আমার কাজ সেইরকম এক রাতে বাবার পাশে মটকা মেরে শুয়ে পড়ার পর নিত্যদিনের মতন চৌকির দুলুনিতে তন্দ্রামতন এসে গেল দুলুনি থামলে তা কেটেও গেল কিছুতেই ঘুম আসে না এদিকে বাবার নাক দিয়ে বাঁশির আওয়াজ বেরোতে শুরু হয়েছে  শুনতে পেলাম দরজার শিকল খোলার আওয়াজ একজন লোক খুব চাপা স্বরে কথা বলছে মায়ের সঙ্গে চোখ বন্ধ করেই পাশ ফিরে শুলাম যাতে আমি লোকটিকে দেখতে পাই আর মা যাতে টের না পায় আমি জেগে গেছি কিছুক্ষণ পর দেখলাম বাবার চোখ খোলা, মুখে কাপড় গোঁজা দুই পা শক্ত করে ধরেছে মা, আর লোকটা বাবার গলায় বুকে পেটে মাংস কাটার চপার দিয়ে এলোপাথারি চালিয়ে যাচ্ছে উঠেই পরতাম তখন, কিন্তু ইচ্ছে হয়নি রক্তে ভেসে যেতে লাগল চৌকির উপর পাতা কাঁথা ভাবলাম এইবার বুঝি আমার পালা নাঃ, কিছুই করল না শুধু দেখলাম মা চৌকির তলা থেকে একটা থলে নিয়ে তার সাথে হাওয়া হয়ে গেল বাবার মুখের থেকে কাপড় সরিয়ে দিলে সেই হাঁ করা বিকৃত মুখের ঠিক নিচে আর একটা হাঁ দেখে কেটে যায় সারারাত পরেরদিন সকালে বস্তিবাসীর হাঙ্গামায় পুলিশ এসে আমাকেই সটান নিয়ে গেল থানায় পারিনি সত্যিটা বলতে নিজের মা বলে কথা শালা সত্যি পাগল আমি লোকে ঠিকই বলে আমাকে নিয়ে

            বিচারে প্রমাণ হল, মানসিক বিকৃতি আছে আমার সরকারি মানসিক আবাসন হল আমার থাকার জায়গা ইল্লি আর কাকে বলে? সময়ে খাওয়া, ঘুমোনো কি জীবন ছিল মাইরি মাঝে মাঝে জানলার বাইরে তাকিয়ে রাস্তার মানুষজন দেখে হেসে ফেলতাম গরমে ঘামতে ঘামতে নতুন জামা-প্যান্ট পরে অফিস যাচ্ছে, কপালে বিরক্তির চিহ্ন এর থেকে শালা পাগলের জীবনই ভাল তবে বেশিদিন সুখ সহ্য হল না একদিন চুপচাপ নিজের খেয়ালে আলুসিদ্ধ দিয়ে ভাত খাচ্ছি, পড়ল এক দলা থুতু আলুর উপরে তাকিয়ে দেখি ন্যাড়া মাথা এক সত্যি পাগল আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে মারলাম কষে তার নিম্নাঙ্গে, চিৎকার করে লুটিয়ে পড়ল মেঝেয় তবুও মনটা শান্ত হল না প্যান্ট খুলে থুতুমাখা আলু ঠুসে দিতে লাগলাম তার পাছায় যৎপরোনাস্তি ছুটে এল সবাই, কিল-চড়-ঘুসি জুটল ভাগ্যে একটা কথাও বললাম না আমি তখন, খালি মার খেয়ে গড়াতে গড়াতে পড়লাম সোজা রাস্তার উপর মুখের উপর বন্ধ হয়ে গেল লোহার গেটকিছুক্ষণ সেখানে পড়ে থাকলে আবার নিয়ে যেত ভেতরে জানতামআমি আর থাকিনি, একটা সম্মান আছে না? সত্যি আমি পাগল

রক্তমাখা ঠোঁট খানিক ধুলো দিয়ে পরিষ্কার করে নেওয়ার পর চলে এলাম প্ল্যাটফর্মে ভাবলাম ফিরে যাই সেই বস্তিতে ওখানে তো আমার ঘর আছে মন সায় দিল না শুয়ে পড়লাম প্ল্যাটফর্মের চাতালে

পাগলা গারদে থাকতে থাকতে একটা গন্ধ মনে হয় লেগে যায় গায়ে মন্থর গতিতে হাঁটা ও করুন মুখ দেখে তারা বিনা বাক্যব্যয়ে আমাকে আগের দিনের বাসি খাবার দিয়ে দেয় পেট ভর্তি খাবার আর অফুরন্ত ঘুম আর কিছু চাই এই জীবনে? হ্যাঁ, চাই তো? মেয়ে সেটাও পেয়ে গেলাম কিছুবছর পর

দিনরাত প্ল্যাটফর্মে থাকতে থাকতে মনটা একঘেয়ে হয়ে উঠেছিল ভাবলাম একটা চেঞ্জ চাই রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে কোনো এক রাতে চলে এলাম পার্ক স্ট্রীট মেট্রোর সামনে প্ল্যাটফর্মে থাকতে মেয়ে আমি প্রচুর দেখেছি তাদের ভেবে হাতের সুখও মিটিয়েছি অনেক তারা আমাকে সবসময় এড়িয়েই চলেছে কিন্তু, এই সং সাজা মেয়েটি দেখলাম আমার দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে তার দিকে যেতে ইশারা করছেটাকা আছেকিনা জিগ্যেস করায় আমি বোকার মতন তার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লাম আমার মাথা কাজ করছিল না তখন লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম তার অর্দ্ধউন্মুক্ত বুকের দিকে

সে আমার হাত ধরে পাশের একটি অন্ধকার গলিতে ঢুকিয়ে নিয়ে গেল একটি ভাঙ্গাচোরা বাড়িতে সামনে বসা একটা মুষকো দারোয়ান কঠিনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল গেট দিয়ে ঢুকেই সামনে একটা উঠোন উঠোনের এক পাশে কতকগুলো খাটিয়ায় শুয়ে কিছু বৃদ্ধ মানুষ তাদের পাশ কাটিয়ে আমরা সিঁড়ি বেয়ে চলে গেলাম দোতলায়ঘরে ঢুকিয়ে মেয়েটি হাত পেতে দাঁড়িয়ে রইল আমি না বুঝতে পেরে তার গালে টকাস করে একটা চুমু খেয়ে বসলাম নাঃ, কোনো প্রতিক্রিয়া তার হল না সে একইরকমভাবে হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকল আমার সামনে

কিছুক্ষন পর নিজেকে আবিষ্কার করলাম শূন্যে সেই দারোয়ান আমাকে পাঁজাকোলা করে তুলে ধরে ছুঁড়ে ফেলেছে রাস্তার উপর ততদিনে আমি অনেক সুন্দর সুন্দর ভাষা শিখেছিলাম ভাবলাম বলি, কিন্তু ইচ্ছা হল নাদাঁড়ালামও না সেখানে আর, সম্মান আছে না আমার?

মনের একঘেয়েমি কাটাতে সেদিন খুব সকালেই বেড়িয়েছিলাম রাস্তায় কিন্তু, আমাকে সেদিন কেউ খাবার দেয়নি হাত বাড়ালেই দুচ্চাই করে তাড়িয়ে দিয়েছিল হয়ত আমার মধ্যে পাগল পাগল গন্ধটা সরে গিয়ে প্ল্যাটফর্মের গন্ধ এসে গেছিল তার উপরে দারোয়ানের কোলে উঠে আবার নেমে পড়া ডাস্টবিনের খোঁজে চলতে চলতে দেখতে পেলাম একটা দুধের শিশু পাশের নর্দমায় পড়ে আছে সম্পূর্ণ উলঙ্গ আর মনে হচ্ছে দেহে কোনো সাড় নেই চক্ষের পলকে তুলে নিলাম পাঁকভরা নর্দমা থেকে দেখলাম শরীরে প্রাণ আছে, আর গায়ের উত্তাপে মাংস সিদ্ধ হয়ে যাবে প্ল্যাটফর্মে এক দয়ালু নেতার কম্বল বিতরন প্রচারে পাওয়া আমার গায়ের কম্বলটি দিয়ে ভালো করে মুড়ে দিলাম তার শরীর ফিরে গেলাম আবার আমার চেনা জায়গায় তাকে নিয়ে               

তারপর কেটে গেছে প্রায় পনেরটা বছর এখন আমার স্বভাবটা একটু খারাপ হয়ে গেছে প্ল্যাটফর্মে লোক দেখলেই আমার তাদের কাছ থেকে পয়সা চাইতে ইচ্ছা করে। ঠিক ভিখারির মতন নয়। “দাদা, একটু মিষ্টি খাব, ১০ টাকা দিন।” কিংবা “চিকেন থালি খাব হেমন্ত হোটেল থেকে, ৭০ টাকা দেবেন?” যারা আমাকে অনেকদিন ধরে চেনে, তারা আমার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলে “কিরে পাগলা মিষ্টি খাবি নাকি? ১৫ টাকা পিস। আমি হাত বাড়ালেই মিষ্টিটা তাদের মুখে পুরোটা ঢুকে যায় আর আমার হাঁ করা নালঝোল পরা মুখের দিকে তাকিয়ে তারা হাসে।

ভালো কিছু খাবার দেখলেই আমার জিভে জল আসে। একমাত্র পূর্ণিমা আমার কষ্ট বোঝে। কিন্তু সেই বা আমার জন্য কতটা করবে? প্ল্যাটফর্মে চায়ের দোকানে কাজ করে, কাজে একটু এদিক-ওদিক হলেই মার খায় আর রাতে আমার জন্য ভাত, ডাল-তরকারি নিয়ে আসে। এখন আর কেউ আমাকে বিনা পয়সায় খেতে দেয় না। সেই শীতের রাতে পূর্ণিমাকে যখন প্ল্যাটফর্মে নিয়ে এসেছিলাম, পরেরদিন সকালে আমার কোলে শিশুটিকে ডেকে সবাই কেড়ে নিতে চেয়েছিল। রেলপুলিশ ডেকে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল আমার কাছ থেকে। পাগলের আবার মেয়ে হয় নাকি? পারেনি তারা আমার কাছ থেকে তাকে নিতে। বুকে আগলে পালিয়ে এসেছিলাম সেই প্ল্যাটফর্ম থেকে অন্য প্ল্যাটফর্মে। বাচ্চা নিয়ে বসলে লোকের মায়াদয়া হয়। আগে ছিলাম শুধু পাগল বাচ্চাটির কান্নার আওয়াজ সহ্য করতে না পেরে তারপর থেকে হয়ে গেলাম পাগলা ভিখারি।  

সেদিন পূর্ণিমা আমাকে বলল – “বাবা, আমাদের সুখ নিশ্চয়ই আছে। সেদিন গোপালদার দোকানে কে যেন বলছিল সুখ-দুঃখ চক্রাকারে আবর্তিত হয়।”

     কি যে এটার আসল মানে তা কে জানে! আমার কাছে তো সুখ মানে পেট ভর্তি আর দুঃখ মানে পেট খালি। মন ভর্তি হয় আমার লোকের মুখঝামটা খেতে খেতেশুধু পূর্ণিমা আমার সকল কথা মন দিয়ে শোনে, আমাকে বোঝায় আর আমাকে রাতে পেট ভরে খেতে দেয়।

এখন আমরা স্টেশনের পাশে সরকারি জায়গায় মাটি আর খড়ের চাল দেওয়া একটা ঘরে থাকিভোররাতে বেড়িয়ে পড়ি আমি শাক-পাতা, লাউ, কুমড়ো, পেঁপের খোঁজেতারপর বাপ-বেটি মিলে চলে যাই প্ল্যাটফর্মে। আজকাল আর হাত পেতে ভিক্ষা করতেও ভালো লাগে না, কিছুক্ষন বসেই চলে আসি ঘরে। সেই থেকে আমি রাত পর্যন্ত পূর্ণিমার অপেক্ষায় বসে থাকি কখন সে আমার জন্য খাবার নিয়ে আসবে, আমার সাথে গল্প করে সারাদিনের ঘটনা বলবে। তারপর সে চালের বেড়ার দুদিকে আংটা করে রাখা পেরেকে শতচ্ছিন্ন কাপড় ঝুলিয়ে পর্দার মতন করে রেখে শুয়ে পড়বেমনটা খারাপ হয়ে যায় তখন আমার। কদিন আগেও আমার পাশে আমার গলা জড়িয়ে শুতো। কিন্তু, একদিন সকালে পেট ব্যথা করছে আর বারে বারে বাথরুমে যেতেই আমি বুঝলাম পূর্ণিমা পরিণত হয়েছে। সেইদিন রাতেও সে আমার পাশে শুয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল – “ বাবা, আমার কেন এত কষ্ট হচ্ছে?” বলিনি কিছু তাকে আমি, শুধুই তার মাথায় হাত বুলিয়ে গেছিলাম। আমি জানতাম কাল থেকেই সে বুঝতে শুরু করবে তার জীবনের পরিবর্তন আর শুরু হবে জীবানুর উৎপাত।

                                  


“কি করে ম্যানেজ করবি?” – কাল্টু জিজ্ঞাসা করল।

“একটা প্ল্যান আছে মাথায়। সেটা হয়ে গেলেই কেল্লা ফতে।” – সান্টু বলল।

“ফেঁসে যাব না তো ভাই?”

“ধুর শালা, এই সব লাইনে এত ভয় পেলে চলে? কার্তিকদা বলছিল নেটে ফেলে দিলেই ১০,০০০ টাকা। ৮০০০ আমার, ২০০০ তোর।”

“এত কমে আমি কাজ করতে পারব না। ৬০০০ তোর ৪০০০ আমার।”

“বাপের কেত্তন নাকি? মেয়ে আমি জোগাড় করব, তুলব আমি আর তুমি শালা ক্যামেরা ফিট করবে তার দাম ৪০০০? ফোট এখান থেকে। ভোলাকে দিয়ে করিয়ে নেব।”

“না না, ২০০০ ই দিস। পয়সা খুব দরকার। এবার বল পূর্ণিমাকে আনবি কি করে এখানে?”

“বিয়ে করব?”

আঁতকে উঠল কাল্টু। বলল –“ নিজের বৌএর শরীর তুই দুনিয়ার সবাইকে দেখিয়ে টাকা রোজগার করবি?”

“আরে ধুর? বানি পিওনের বর পেয়েছিস নাকি আমাকে? বিয়ে কালিঘাটে হবে। কাগজপত্র ছাড়া বিয়ে হয় নাকি? কিন্তু পূর্ণিমার মাথায় লাল সিঁদুর দিলেই ও ভাববে আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে। তারপরেই আমাদের খেলা শুরু।”

“জানলে যদি পুলিশে বলে দ্যায়?”

“সেটার সুযোগ তো দেবো না চাঁদ। তার আগেই হাপিশ করে দেব। কথা হয়ে গেছে সোনামাসির সাথে। ৫০০০০ দেবে বলেছে। আর যখন ঢুকবে, বেরোনোর চান্স নেই।” – খিকখিক করে হেসে উঠল সান্টু। গুটখার ছোপ খাওয়া দাঁতগুলো আরো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছে তার হাসিতে।

কাল্টু দাঁতগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল – “কিন্তু, পূর্ণিমা তো খুব ভালো মেয়ে। নিজের মতন কাজ করে খায়, পাগল বাবাটাকে দেখে। তার এতবড় সর্বনাশ করবি?”

খেঁকিয়ে উঠল সান্টু। বলল – “ ওরে আমার যখের ধন রে। খুব দরদ দেখছি পূর্ণিমার উপরে? পারলে পটিয়ে দেখা না একবার। শালা কেলো মাল। তোর দিকে কোনো মেয়ে তাকাবে ভেবেছিস? গিয়েছিলি তো প্রথম প্রথম পূর্ণিমাকে লাইন মারতে, পাত্তাই তো পেলি না। একদিন শুনেছিলাম তোকে নাকি ঝাঁটা হাতে তাড়া করেছিল।”

আবার সেই ছোপ খাওয়া দাঁতের হাসি। মাথায় আগুন জ্বলে উঠল কাল্টুর। তবুও শান্ত মাথায় বলল –      “তাই জন্যই তো প্রতিশোধ নিতে চাই রে ভাই

“পথে এসো বন্ধু। আর আমি তো পূর্ণিমার উপকারই করছি। বাপটা পাগল। মেয়েটা চায়ের দোকানে কাজ করেএর থেকে সোনাগাছিতে দিনে দুইবার ভাত খাবে আর রাতে শরীরের জ্বালা মেটাবে।”

তাকিয়ে রইল কাল্টু সান্টুর দিকে। জিজ্ঞাসা করল – “কবে?”

“পরশু”।

                                  

আমার বাবাকে লোকে পাগল বলে। ভাবলেই আমার হাসি পায় এত ধুরন্ধর মানুষ আমি খুব কম দেখেছি আমার এই পনেরো বছরের জীবনেআমার বাবা শুধু খেতে ভালোবাসে। আর হ্যাঁ আমাকেও খুব ভালোবাসে। যখন তাকে আমি রাতে খেতে দিই তখন বলে আমি তার নয়নের মণি। আর যখন সকালে কাজে বেড়িয়ে যাই, তখন প্ল্যাটফর্মের লাগোয়া চায়ের দোকানে এসে আমার কাছে খাবার চাইলে আমি নিজের খাবার থেকে খেতে দিলে গোপালদার কাছে মার খাই। কারণ আমি নাকি কাজ না করে আমার পাগল বাবার সাথে আড্ডা দিচ্ছি।

বাবা বলে যে আমার মা নাকি আমাকে জন্মের পরেই বাবার কাছে রেখে দিয়ে পালিয়ে গিয়েছে। জ্ঞান হওয়া ইস্তক দেখে চলেছি রেললাইন, ট্রেন আর প্ল্যাটফর্ম। বাবা আমাকে কোলে নিয়ে ভিক্ষা করত। লোকের মুখে মুখে কথা শুনে আমার কথা বলা শুরু। বাংলা আর হিন্দি পুরোটাই জানি, আর ইংরেজি বলতে না পারলেও বুঝতে পারি। পড়তে আমি পারি না। তবুও ঘড়ি দেখা, টাকা-পয়সা গোনা এইসব আমার মধ্যে অজান্তে এসে গেছে।

প্রায় দশ বছর হয়ে গেল আমার গোপালদার চায়ের দোকানে। আমি আমার সব সুখ চালচুলোহীন বাবার জন্য শেষ করে দিয়েছি। এত ধুরন্ধর কিন্তু নিস্তেজ মানুষ হয়ত এই দুনিয়ায় একটাই আছে। আমার বাবাকে আমি খুব ভালোবাসি, তাকে ছেড়ে থাকার কথা আমি ভাবতেই পারে না। কিন্তু আমার মন যে সবসময় সান্টুর জন্য উতলা হয়ে থাকে, আমি যে তাকেও ছেড়ে থাকতে পারছি না

গতবছর কালীপুজোয় গোপালদার চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে যখন রেললাইন পার হচ্ছি, খেয়াল করলাম কে আমার পিছু নিয়েছে। ভাবলাম আমার বাবাই হবে। পিছন থেকে দেখছে আমি কোনো খাবার নিয়ে যাচ্ছি কিনা। তারপর ভাবলাম যদি কোনো বদমাশ লোক হয়? জোরে জোরে পা চালাতে লাগলাম। আমার গতিকে উপেক্ষা করে সামনে এসে দাঁড়াল গোপালদার ছোট ছেলে সান্টুদা। হাতে একটা মোবাইল। মোবাইলটা আমার দিকে এগিয়ে বলল – “তোকে আমি খুব ভালোবাসি।”

শুনে আমি পুরোপুরি হতভম্ব। আমার সারাদিনের বাসন মেজে হেজে যাওয়া খসখসে ডানহাতটাকে তুলে মোবাইলটা গুঁজে দিয়ে বলল – “এটা তোকে গিফট দিলাম। আমরা সারারাত ফোনে কথা বলব।” বলেই গালে একটা টকাস করে চুমু দিয়ে চলে গেল। রাগ করিনি। বরং ভালোই লেগেছিল। ইদানিং ভালো চেহারার পুরুষ দেখলেই আমার শরীরে কেমন জ্বালা করে। সান্টুর চুমু সেদিন আমার সব জ্বালা নিবিয়ে আমাকে তার শরীরের সর্বস্ব পাওয়ার জন্য আরো বেশি কামার্ত করে তুলেছিল।

 আজ আমাদের বিয়ে। গত পরশু রাতে সান্টু ফোনে আমাকে বিয়ের কথা বলার পরেই আমার বুকে একটা আলোড়ন চলছিল। সেটা আনন্দের নাকি ভয় তা এখনো আমি বুঝিনি। কিন্তু, এটা জানি সান্টু আমাকে ভালোবাসবে। না হলে কেউ বলে –“ তোর পুরনো স্মৃতির কিছুই আনবি না। রেশন কার্ডও না। তোর নতুন পরিচিতি তৈরী করব আমি। তোকে এমন সুখ দেব তুই ভাবতেও পারবি না

বাবার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু, আমি কেন নিজের জীবন নষ্ট করতে যাব আমার পাগল বাবার জন্য? আমি চাই পাখির মতন বাঁচতেআর সেটা একমাত্র সম্ভব সান্টুকে বিয়ে করলে। গোপালদাকে বাবা বলতে হবে এই ভেবেই আমার হাসি পাচ্ছে। সেদিন দোকানে সেই লোকটা ঠিকই বলছিল –“ সুখ-দুঃখ চক্রাকারে আবর্তিত হয়।”

                                                                                 

আমাকে লোকে পাগল বলে ভাবলেই আমার হাসি পায় আমি তো সত্যি পাগল এখন আমার গায়ে এখন শুধুই জামা আছে, প্যান্ট নেই জামাটা খুলে ফেলব একদিন পুরো উদোম হয়ে ঘুরে বেড়াব এখন আবার আমি খাবার পালোকের কাছে বিনা পয়সায় কেউ কেউ গায়ে জল ছিটিয়ে দুর-দুর করে তাড়িয়েও দেয় আমি মুখে বিড়বিড় করে সরে যাই সেই জায়গা থেকে দাঁড়াই না আর, একটা সম্মান আছে না আমার? 

                                                                                 

পার্ক স্ট্রীটের রাস্তার মোড়ে সান্টু আর কাল্টু সিগারেট টানছে, আর পাশ দিয়ে কোনো লোকজন গেলেই জিজ্ঞাসা করছে – “লাগবে কিনা।” টুসকি একটু দূরে দাঁড়িয়ে সং সেজে অপেক্ষা করছে কখন কাস্টমার এসে তার হাত ধরে তাকে নিয়ে যাবে। দূরে একটি দাড়িওয়ালা, মাথায় ধুলো, নিম্নাঙ্গ অনাবৃত, চিটচিটে ময়লা একটি জামা পরা তার দিকে এগিয়ে আসছে। কাল্টু দেখে বলল – “এই টুসকি, তোর কাস্টমার”। বলেই ফিক করে হাসল।

একসময়কার পূর্ণিমা দেহব্যবসার দুনিয়ায় টুসকি মুখ তুলে চেয়ে বলল – “ভাগ শালা”।

পূর্ণিমা দেখছে লোকটা তার কাছেই আসছে। সে পিছন ফিরে গেল। একটি হাত তার পিঠের উপর পরতেই কাল্টু আর সান্টুর একসঙ্গে খিলখিলিয়ে হাসির আওয়াজ শুনতে পেল ওপ্রস্তুত ছিল পূর্ণিমা। সামনে ঘুরে সপাটে লোকটার গালে একটা চড় বসিয়ে দিল। হাত সরাতে পারল না। ঝড় আসার আগে গাছের পাতা গুলো যেমন হাল্কা নড়ে ওঠে, পূর্ণিমার ঠোঁটও সেই ভাবে নড়ে উঠল তার বাবাকে দেখে। কাঁচা-পাকা দাড়ির ময়লা আরো বুড়ো করেছে বাবাকে। পূর্ণিমা বাবার গালে হাত বোলাতে বোলাতে বলল – “কেমন আছ বাবা?” সঙ্গে সঙ্গে চোখের জলের বাগধারা গড়িয়ে পড়ল কাঁচা-পাকা দাড়ির উপর। মেয়ের দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বলে উঠল – “ ভালো না মা। কতদিন তোকে দেখিনি। আমাকে একটু খেতে দিবি মা? কতদিন তোর হাতে বেড়ে দেওয়া ভাত খাইনি।”

পূর্ণিমা একবার কাল্টু, একবার সান্টুর দিকে তাকাল তাদের মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে ইশারা করে নাবলছে তাকে পূর্ণিমা পরোয়া না করে বাবাকে নিয়ে চলল পার্ক স্ট্রীট মেট্রোর পাশের অন্ধকার গলি দিয়ে পিছনে কাল্টু আর সান্টু গেটের সামনে দাঁড়ানো পনের বছর আগে দেখা সেই মুষকো দারোয়ান কাল্টুর ইশারায় সে গেটের সামনে দাঁড়াল পূর্ণিমা হাত সরাতে বললে দারোয়ান নড়ল না সেখান থেকে গলার আওয়াজ বাড়ল পূর্ণিমার সান্টু এসে পিছন থেকে তার মুখে হাত চাপা দিয়ে ঢুকে পড়ল বাড়িটার মধ্যে নিম্নাঙ্গে জোর বজ্রাঘাত করল কাল্টু লুটিয়ে পড়ল পাগলা বাবা


সম্মান আছে বটে পাগলা বাবার যন্ত্রনা কমে যাওয়ার পর দাঁড়ায়নি আর সে উঠে এগিয়ে চলেছে খাবারের খোঁজে যদি কোথাও ডাস্টবিন পাওয়া যায় অথবা নর্দমার মধ্যে মৃতপ্রায় একটি শিশু 

No comments:

Post a Comment