হটাৎ-ই ঘুম ভেঙে গেল চিরঞ্জিতের। সকাল সাড়ে ছটা,
বিছানা ছেড়ে সে বাথরুমে গেল, ফিরে এসে নিজেকে বারান্দার ইজি চেয়ারে এলিয়ে দিল।
ভোরের ফুরফুরে হাওয়ায় তার অসুস্থ শরীরটা আরেকটু ঘুমোতে চাইল। আরামে চোখ বন্ধ হয়ে
আসল তার। হটাৎ-ই তার চোখের সামনে ভেসে উঠল প্রতিমার মুখ। প্রতিমা চিরঞ্জিতের
স্ত্রী। মাত্র ছ’মাসের দাম্পত্য জীবন তাদের। দেখেশুনেই বিয়ে। কোনপূর্বপরিচিতি ছিল
না আগে। কিন্তু মাত্র ছ’মাসেই সে প্রতিমাকে খুব ভালবেসে ফেলেছিল। কিন্তু
হটাত-ই...প্রতিমা চলে যাওয়ার পর খুব একলা হয়ে পড়ে সে। জীবনে এক অপূরণীয় শূন্যতা
সৃষ্টি হয়, কোন কিছুতেই মন লাগে না। এই ছ’মাসে প্রতিমা তার অজান্তেই অভ্যেসে পরিণত
হয়েছিল। দিনটা অফিসে কোনরকমে কেটে গেলেও, সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে তার সময় কাটতে চাইত
না। রাতের বিছানায় সে বিছে কামড়ানো জ্বালায় জ্বলত। এসব কথা তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু
সৌমেনকে বলেছে মাঝে মাঝে। অবস্থা বুঝে সৌমেন তাকে একদিন নিয়ে যায় বি.কে.পাল
স্ট্রীটে।
১১২/২ বি.কে.পাল স্ট্রীটে মানসীর ঘর। সৌমেনের সূত্রেই ওর আলাপ হয় মানসীর সাথে।
প্রথম দৃষ্টিতেই মানসীর উপচে পরা যৌবন, নিটোল ভরন্ত শরীর চিরঞ্জিতকে আকৃষ্ট করে।
তার অর্ধপ্রজ্বলিত বক্ষ সন্ধি চিরঞ্জিতের মনে জাগিয়ে তোলে তীব্র কাম্নার আগুন।
কয়েকটা শুখনো কাগজের পরিবর্তে মানসী তাকে নিয়ে যায় অচিন স্বর্গদ্যানে, যেখানে
সে খুঁজে পায় তার সুখপাখি, গভীর উপত্যকায় সে আঘ্রাণ নিয়েছিল মানসীর গচ্ছিত
পুস্পভান্ডারে, ভিজে গিয়েছিল কুয়াশাবিন্দুতে।
মানসী, প্রতিমার প্রতিবিম্ব না হলেও সে চিরঞ্জিতের থমকে যাওয়া জীবনকে
প্রবাহমান করে তোলে। ধীরে ধীরে সে চিরঞ্জিতের মনের বারান্দায় গেয়ে ওঠে ভালোবাসার
কুহুতান। চিরঞ্জিতও সে কুহূতানে সাড়া দেয়। মানসী প্রবেশ করে তার অন্দরমহলে। রাতারাতি
মানসী হয়ে ওঠে চিরঞ্জিতের সুতনুকা।
রতিক্রান্ত অবস্থায় মানসীর বাহুবন্ধনে চিরঞ্জিত আশ্লেষ জড়িত স্বরে বলে ওঠে-
- সুতনুকা, আমার সুতনুকা।
- বাবু, সে কে গো ! তোমার বউ?
- না, তুমি, তুমিই আমার সুতনুকা।
- কিন্তু, মানে কি এর?
- সুন্দর তনু, মানে সুন্দর শরীর যার।
খিলখিলিয়ে হেসে উঠেছিল মানসী। চিরঞ্জিতকে প্রশ্ন করেছিল- আমাকে এতো ভালোলাগে?
আমাদের যে সবাই ঘেন্না করে!
চিরঞ্জিত সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে প্রতি প্রশ্ন করেছিল- সুতনুকা, তুমি আগে
কোনদিন কাউকে ভালোবেসেছ?
ছলছলে চোখে ধরা গলায় মানসী বলেছিল- বাবু, সেই ফ্রক থেকে শাড়ী অবদি এই কাজটাই
করছি। কত ব্যাটাছেলে আসে রোজ, তারা শুধু শরীরটাই চায়, মনটা না। তাই আমিও মনের
খিলটা খুব কষে বেঁধে রেখেছিলাম। কিন্তু, তুমি সেই খিলটা খুলে দিলে। এখন থেকে এই
শরীর, মন সব কিছুরই মালিক তুমি। কয়েকটা কাগজ দিয়ে তোমার সুতনুকা কে আর কেউ ছুঁতে
পারবে না।
চিরঞ্জিত একটা দীর্ঘচুম্বন এঁকে দেয় ওর কপালে। মাস খানেক ধরে চিরঞ্জিত
টায়ফয়েডে শয্যাশায়ী। প্রথম দশদিন তো প্রায় কোন হুঁশ ছিল না। ধীরে ধীরে অবস্থার
উন্নতি হলেও এখনো পুরোপুরি সুস্থ নয়। ডাক্তার বলেছে আরো দিন পনেরো কমপ্লিট
বেডরেস্ট। কিন্তু চিরঞ্জিতের আর ভালো লাগছে না। কতদিন সুতনুকার কাছে যাওয়া হয় নি।
এই একমাসে ওকে ফোনও করা হয় নি। প্রথমদিকে সুযোগ ছিল না, পরের দিকে থাকলেও আর করা
হয়নি। আজকে সে যাবে সুতনুকার কাছে। সুতনুকা নিশ্চয়ই খুব অভিমান করেছে। আজ বুকে
টেনে ধরে খুব আদ্র করবে চিরঞ্জিত।
সিঁড়ি বেয়ে চলতে চলতে সে ভাবতে থাকে সুতনুকার মুখটার কথা। খুব মিষ্টি লাগছে
তাকে।
দোতলার ঘরের দিকে এগোতেই চিরঞ্জিত চমকে উঠল। এক পাঞ্জাবী পরা লোক ঘামে জবজবে
অবস্থায় সুতনুকার ঘর থেকে বেড়িয়ে আসছে। লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখ
ভারি আসলে বিদ্যুৎ গতিতে প্রবেশ করল সুতনুকার ঘরে।
চিরঞ্জিতকে দেখে মানসী চমকে উঠল, সে চিরঞ্জিতের চোখের দিকেও তাকাতে পারল না,
শুধু মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল। চিরঞ্জিত চিৎকার করে বলে উঠল – ছি, ছি, আমাকে
তুমি এইভাবে ঠকালে! আমাকে মিথ্যে বলেছিলে যে সুতনুকা শুধু আমার !
সুতনুকার গলকণ্ঠটা ওঠানামা করতে লাগল। তার চোখ থেকে বেয়ে পড়ল অশ্রুধারা।
সুতনুকা যেন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় চিরঞ্জিত ভাঙা গলায় বলে উঠল-
আমার সুতনুকা এত সস্তা হতে পারে না , সে খুব মূল্যবান।
বিধ্বস্ত বুক নিয়ে চিরঞ্জিত ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।
সুতনুকা বলতে চেয়েও বলতে পারেনি যে, পেটের দায়ে সে সুতনুকা থেকে আবার মানসী
হয়েছে। আর মানসী তো এই একটা কাজই ভালো পারে।
বিকেল হয়ে গেছে, চিরঞ্জিত স্টীমারে। সে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পশ্চিমের
লালরঙা সূর্যটার দিকে। নীচ দিয়ে একটা কুকুরের বাচ্চার মৃত দেহ ভেসে যাচ্ছে । স্রোতের অনুকূলে, প্রবাহের অনুকূলে।
No comments:
Post a Comment