১
এখানে জঙ্গল আরো গভীর। কিছুটা আগে যেখানে কিছু মানুষের হঠাৎ আগমন উপলক্ষ্যে একটা ক্ষণিকের আস্তানা
গড়ে উঠেছে তার থেকে গভীর, ঘন তো বটেই। এখানে গাছগাছালি বিচ্ছিন্ন নয়, পাখিদের এক গাছ থেকে আরেক গাছে যেতে অনেকটা ফাঁকও পেরোতে
হয়না। অখণ্ড নীরবতার মাঝে থেকে থেকে
পাখি ডেকে উঠছে বটে তবে তাও ভীষণ স্তব্ধ যেন। জলের তলায় পুরো শরীর নিয়ে গেলে যেমন লাগে এই ঘন জঙ্গলের ভেতরেও
তেমন লাগছে। তেমনি শব্দহীন, গতিহীন। অন্তত বছর এগারোর ছেলেটার
তো লাগছে। ছেলেটা ভয় পাচ্ছে। তার চোখ- মুখে ভয় ভয় ভাব। হঠাৎ কাছেই একটা পাখি
ডেকে উঠলো। পরিচিত নয় পাখির ডাকটা। কেমন যেন। আর তাই ভয় পেয়ে ছেলেটি পাশের মেয়েটির হাত চেপে ধরলো। একটু বেশীই জোর দেওয়া হয়ে
গেল বোধহয়। মেয়েটি হাতটা ছাড়িয়ে নিল। রোগা রোগা পাঁচ আঙুলের চাপে মেয়েটির চোখ - মুখ যন্ত্রনায় কুঁচকে উঠলো। তারপরই সামলে নিয়ে ছেলেটির সামনে ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে
বললো,
' ভয় করছে নাকি? '
' হ্যাঁ' ও ' না ' দুইই হতে পারে। মেয়েটি হয়তো ' না' ই ধরলো। ছেলেটাকে তার সঙ্গে চলতে ইশারা
করে এগোতে লাগলো। ছেলেটা তবু একইরকম। মেয়েটিকে আরো যেতে দেখেই তার ভয় হয়তো বেড়ে গেল। এবার সে দুই হাত দিয়েই মেয়েটির হাতটা পেঁচিয়ে ধরলো। বছর সতেরোর মেয়েটি একবার থামলো। ইতিউতি দেখলো চারপাশ। যে জায়গায় তারা পিকনিক
করতে এসেছে তার থেকে বেশ কিছুটা দূরেই চলে এসেছে। ছেলেটার কানের লতিতে নিজের ঠোঁট ঠেকিয়ে বললো, ' ভয় নেই। চুপ। আমি সব ভয় তাড়িয়ে দিতে পারি। ' মেয়েটির এমন কথায় ছেলেটাকে এখন নিশ্চিন্ত দেখাচ্ছে কিছুটা। মেয়েটা ছেলেটাকে নিয়ে সরে
এলো একটু পাশে। আশপাশ আরো একবার দেখলো। তারপরই সাপের মতো করে পেঁচিয়ে ধরলো। ছেলেটা এবার অবাক হতে শুরু করেছে। আর অবাক হতে হতে তার মুখ- চোখে আবার ভয়ভাবটা ফিরে আসছে। পরিচিত মেয়েটিকে তার এখন
অপরিচিত লাগছে। ওর এখন ভয় করছে। মেয়েটি আস্তে আস্তে ওকে ক্রমশ নিজের মধ্যে নিয়ে নিচ্ছে যেন। উন্মত্ত সেই মুখ দেখে তার
মনে হচ্ছে বুঝি কোনো ভ্যাম্পায়ার। ও চিৎকার করে উঠতে গেল ব্যাথায় কিন্তু মেয়েটি ওর মুখ চেপে ধরলো একহাত দিয়ে। ভীতু ছেলেটার এবার কান্না
পাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে সে দেখলো
অনেককিছু কিন্তু কিছুই তার বোধগম্য হলোনা। মেয়েটি কেমন হাঁফাচ্ছে। সারা শরীর জুড়ে চকচক করা ঘামের ফোঁটা জলের ধারা হয়ে নেমে
আসছে। একসময় মেয়েটি থামলো। আরো কিছুক্ষণ পর হেসে কি
যেন বললো। ছেলেটা তা শুনতে পারলোনা। বরং সে ব্যাথায় কান্নাভেজা
চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটি সালোয়ার গোছাতে গোছাতে আরো কিসব যেন বলছে। কিন্তু কিছুই শোনা যায়না। বরং এবার দৃশ্যটা বদলাতে শুরু করেছে। ক্রমশ ঝাপসা হচ্ছে সব কিছু। ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে সব। একসময় পুরো দৃশ্যটাই অন্ধকার
হয়ে যায়। ঠিক সেসময় ছেলেটার মুখ
দিয়ে চাপা গোঙানির আওয়াজ বের হলো।
ধড়মড় করে উঠে বসলো সুতীর্থ। আজ আবার সেই স্বপ্ন! হুবহু এক। একই জায়গায় শুরু একই জায়গায় শেষ। স্বপ্নটা, সেই কবে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা সেতো প্রায় ভুলে যেতেই বসেছিল। কিন্তু এখন সুতীর্থ বুঝতে
পারছে সে কিছুই ভোলেনি। গত পাঁচ মাসে এই নিয়ে চারবার দেখলো সে স্বপ্নটা। ওর পুরো শরীরে ঘাম চটচট করছে। গোঙানির ফলে গাল বেয়ে গড়িয়ে নামা লালাটা সে হাতের চেটো
দিয়ে মুছে ফেললো। ঘরে জ্বলা হালকা নীল আলোয় সে দেখলো সঙ্গীতা কাত হয়ে ঘুমোচ্ছে। সুতীর্থর গোঙানিতেও ওর ঘুম
ভাঙেনি। সুতীর্থ দেখেছে গত তিনবারের
বারও ভাঙেনি। সঙ্গীতার পিঠটা খোলা। বেড কভার ওর পুরো শরীরটা ঢাকতে পারেনি। সুতীর্থর চোখ হঠাৎ জ্বলজ্বল করে ওঠে। সঙ্গীতার দিকে সে ক্রমশ
সরে আসতে লাগলো। যেমন করে সিলিঙ ধরে টিকটিকি এগোয়। সেরকম করে সুতীর্থ যখন এগোচ্ছে ঠিক সেসময় ড্রেসিংটেবিলের পিছনে একটা শব্দ
হলো। সে মাথাটা তুললো। নিশ্চয় ছুঁচো অথবা ইঁদুর। ঠিক কি তা খুঁজতে গিয়ে সুতীর্থর
চোখ পড়লো আয়নাতে। আর পড়ামাত্রই চমকে উঠলো। এটা কি সে? কি বীভৎস চোখের চাহনি। হালকা নীল আলোয় সেই আবছা প্রতিবিম্ব দেখে সুতীর্থর ভয় লাগলো। সে দ্রুত নেমে এলো খাট থেকে। দরজা খুলে বেরিয়ে এলো পুবের বারান্দায়। দেশলাই ঠুকে সিগারেট
জ্বালালো। সিগারেট টানতে টানতে সে দেখলো
তার সামনেটা। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয় কিছুটা অংশ আলোকিত হয়ে উঠেছে। সিগারেট শেষ করে সে ঘরে
আসে। বাকি রাতে আর ঘুম আসবেনা। তবু সে শুয়ে পড়লো। সঙ্গীতা এখন সোজা হয়ে শুয়েছে। চাদরটা ভালো করে ওর গায়ে
জড়িয়ে দিল। একফোঁটা চোখের জল চাদরের ওপর ঝরে পড়লো। দ্বিতীয় ফোঁটাটাকে সে মাঝপথেই ধরে ফেললো। চোখের জল বড়ো বালাই। না পড়তে দেওয়াই ভালো।
২
তেমাথার মোড়টা আজ একেবারে খাপছাড়া। শুনশান। রোজকার মতো গাড়ির হর্ন, কন্ডাকটরের কর্কশ গলায় চিৎকার, মানুষজনের হই- হল্লা নেই। চারপাশের দোকান গুলোও সব বন্ধ। অথচ এখন বিকেল পাঁচটা বাজে। আশেপাশের এলাকার মধ্যে এটা একটা ব্যস্ততম এলাকা। আজ সব ব্যস্ততা কোনো যাদুঘরে রাখা আছে বুঝি। সুতীর্থরা দাঁড়িয়ে আছে যে
চায়ের দোকানের সামনে সেটাও এখনো খোলেনি। বাইরের বাঁশের চঁটা দিয়ে বানানো বেঞ্চিটাও ফাঁকা। অন্যদিন এসময়েই এখানে জমাট আড্ডা শুরু হয়ে যায়। আজ সব ফাঁকা। সেইসব মানুষদের ছাড়া বাঁশের
বেঞ্চিটাকে দেখাচ্ছে কঙ্কালের মতো।
' নাহ! আজ বাড়ি থেকে বেরোনো একদমই উচিত হয়নি দেখছি। একটা বাসও পাচ্ছিনা। আধঘণ্টা হয়ে গেল। ' সমরেশ উশখুশ করে উঠে পড়ে। অস্থিরভাবে পায়চারি করতে করতে সামনে পড়ে থাকা ছোট্ট পাথরের
খোয়াটাকে বিরক্তিতে ডান পা দিয়ে লাথ মারে। পাথরটা নড়েনা। সমরেশের বুড়ো আঙুল ব্যাথায় কুঁকড়ে যায়। ' একটা অটোও নেই। সরকার নাকি বনধ আটকাবে, বাস চালাবে তা কই? '
সরকার নয়, সুতীর্থকেই প্রশ্ন করে সমরেশ। সুতীর্থ হাসে। তারপর বলে, ' পাথরে লাথি মেরে আরো বিপদ ডেকে আনবে ব্রাদার। চুপচাপ বসো এখানে। তুমি না আরো অনেকেই এই সিচুয়েশনে আছে। '
সমরেশ একটু থমকায়। ' সিচুয়েশন ' শব্দটা ওকে ভাবায় বোধহয়। তারপর বলে, ' ধ্যাত! তোমার এই এক দোষ। সুযোগ পেলেই বাণী ঝাড়ো। কি হতো আজ না আসলে? তোমার জন্যই তো এলাম। বললে অসুবিধা হবেনা, এদিকে নাকি বিরোধী দলের জোর নেই তেমন। অথচ দেখো দিব্যি বনধ করে দিল। '
সুতীর্থ কিছু বলেনা চুপ থাকাই ভালো। মিটিমিটি হাসে কেবল। আজ সত্যিই সমরেশদা আসতে
চায়নি। গত পরশু সন্ধ্যার সময় হঠাৎই
সবাইকে চমকে দিয়ে বিরোধী নেতা রজত সেনগুপ্ত ঘোষণা করেন, আগামী বুধবার তারা
স্বতঃস্ফূর্ত বনধে নামছেন। সমগ্র রাজ্যবাসীকেও তিনি এই বনধ সফল করবার জন্য আহ্বান জানান। খবরটা দেখে সুতীর্থ অবাক হয়েছিল। তারপর মজাও পেয়েছিল। জীবন থামাতে মানুষকে
আহ্বান!
তবে নিমন্ত্রণে
যে অনেকেই খুশি তা পরদিন অফিসে গিয়েই ও টের পেয়েছিল। একাউন্টসের শ্যামল বাগচি দাঁত কেলিয়ে বলেছিল, ' মুখ্যমন্ত্রী এবার ঠেলা বুঝবে! সাধারণ মানুষ যে এখনো প্রতিবাদ
করতে জানে তা বোধহয় ভুলে গেছিল। ' বলার পর শ্যামল বাগচি একটা বিশ্রী খিস্তি করেছিল।
' জীবনকে স্তব্ধ করে কি প্রমাণিত হবে শ্যামলদা? ' মুখ না তুলেই জিজ্ঞেস করেছিল কৃষ্ণেন্দু।
' মানে? ' শ্যামল বাগচির দাঁত কেলানো বন্ধ হয়ে গেছিল। অস্তিত্ব সংকটে ভোগা ভুরু দুটো কুঁচকে গেছিল। তারপর বলেছিল, ' তুমি বুঝবে না। তোমরা ভাই কবিতা টবিতা লেখো। তোমাদের এসব বালাই নেই। রাজ্যে চাকরি নেই, শিল্প নেই। বনধ তাই দরকার। খুব দরকার। বিপ্লব চাই! বিপ্লব! ' শেষের তিনটি শব্দ একটু
নাটকীয় করে বলে শ্যামল বাগচি।
কৃষ্ণেন্দু একটু চুপ করে থাকে। তারপর বলে, ' বনধ কখনো বিপ্লব হয়না শ্যামলদা। বিপ্লব এমন হয়না। আর কেন্দ্রে তো আপনাদের দলই আছে। তাতেই বা কি হচ্ছে! '
' কাল তাহলে তুমি আসছো '?
' হ্যা আসছি। '
বাড়ি ফেরার সময় বাসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সমরেশ বলেছিল, ' কাল তুমিও আসছো নাকি? '
' দেখা যাক। ফোন করবো তোমাকে । ' সুতীর্থ তখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। যদিও ফোন তাকে করতে হয়নি। ভোর ছটার সময় সমরেশদাই ওকে ফোন করেছিল। সুতীর্থ তখনো বিছানা ছাড়েনি। ফোনটা কানে চেপে ঘুম
জড়ানো গলায় হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এসেছিল সমরেশের গলা ' আসছো নাকি? '
সমরেশকে জানিয়েছিল সে আসছে। সারাটা দিন নাহলে ঘরের মধ্যে বসে থাকা। সঙ্গীতার সঙ্গ আজকাল অসহ্য লাগছে ওর।
'' চুপ মেরে গেলে যে! কি ভাবছো? " সুতীর্থ বর্তমানে ফিরে
আসে সমরেশের প্রশ্নে।
" কিছুনা। তুমি বসোতো এখানে। অস্থির হয়ে লাভ আছে? "
সুতীর্থর কথায় সমরেশ হাসে। ভীতু, অসহায় মানুষের হাসি।
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ। সুতীর্থ একমনে সিগারেট টেনে যায়। আপাতত সে কি যেন ভাবছে। ভাবছে বলেই কখনো ঘনঘন আবার কখনো দেরিতে শিগারেট টানছে। সমরেশের অস্বস্তি হয়। সে বেশিক্ষণ চুপ থাকতে
পারেনা। একটু পরেই বলে, " এসে অবশ্য লাভই হলো! না আসলেই বরং অসুবিধা হতো। "
" লাভ কিরকম দাদা? " সুতীর্থ একটু অবাক হয়।
" আরে বিরোধীদের বনধ সত্তেও আমরা প্রেজেন্ট থাকলাম। চেয়ারম্যান খুশি হবে এতে! " বিয়াল্লিশের সমরেশকে বিগলিত দেখায়। সুতীর্থ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সমরেশের দিক। তারপরই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে
নেয়। ওর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। এখন আস্তে আস্তে চারপাশ স্বাভাবিক
হচ্ছে। দোকানপাট খুলছে। সুতীর্থ হাতঘড়িতে সময় দেখে-- ৫ টা ১০। চেয়ারম্যানটা শালা
হারামির একশেষ। কোনো কাজ নেই অথচ পুরো পাঁচটা পর্যন্ত সবাইকে বসিয়ে রাখলো। শালা পা চাটা পাব্লিক। বাঞ্চোত একটা। সুতীর্থ অর্ধেক পোড়া
সিগারেটটা মাটিতে ফেলে দেয়। দিয়েই পিষতে থাকে যতক্ষণ না সেটা থেতলে যায়।
শরৎ আবাসনের সামনে সুতীর্থ যখন পৌছালো তখন প্রায় রাত আটটা বাজে। চারপাশটা অন্ধকার হতে হতে
হয়নি। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ
আলোটা জ্বলছে। দোকানপাট প্রায় সবই বন্ধ। সকালের রেশ রয়ে গেছে হয়তো। এলাকাটা কেমন ঘোলাটে লাগে। সুতীর্থর চোখ চলে যায় তাদের ফ্ল্যাটের দিক। অধিকাংশ ফ্ল্যাটের থেকেই ভেসে আসছে টিভির আওয়াজ। ওর ঘরের থেকেও আসে। জানালাটার পর্দাও দেওয়া আছে। শালা ওর বাড়িতেও বনধ নাকি
আজ! সুতীর্থ বাড়ির দিক এগোয়। লিফট নয় সিড়িই ব্যবহার
করে সে। নিজের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ায়। বন্ধ আছে। সেটাই স্বাভাবিক। সুতীর্থ সাদা কলিংবেলটায়
চাপ দেয়। ভিতর থেকে কোনো সাড়া নেই। সুতীর্থ বিরক্ত হয়। দ্বিতীয়বার একটু জোরেই
চেপে ধরলো সে সুইচটা । কাজ হলো। দরজা খুলে দিয়েছে সঙ্গীতা। সুতীর্থ ধমকাতে গিয়েও পারেনা। সঙ্গীতার মুখ দেখে থমকে যায়।
ঘরে ঢুকে ঘামে ভেজা জামা ছাড়তে ছাড়তে সুতীর্থ বলে, ' কি হয়েছে? মুখের ভাব অমন কেন? '
সঙ্গীতা চুপ করে থাকে। জবাব দেয়না। অথচ সে তাকিয়ে আছে সুতীর্থর দিকেই। অস্বস্তি নিয়ে সুতীর্থ প্রশ্ন করে, ' কি হলো? '
' মামা মারা গেছে। '
সুতীর্থ অবাক হয়। ' কবে? '
' আজই। সকালের দিক। হার্ট এটাক। একটুও টাইম দেয়নি। ' সঙ্গীতা মাথা নীচু করে ফেলে। গাল বেয়ে গড়িয়ে নামতে থাকে জলের ধারা। সুতীর্থর অস্বস্তি হয়, সে কাউকে সান্ত্বনা দিতে পারেনা। জানেনা কি করে কি করতে হয়। সঙ্গীতা ওর বড়মামার কাছে মানুষ। কিন্তু সুতীর্থকে এই মৃত্যু একেবারেই অভিভূত করতে পারছেনা। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে
থাকার পর সে নির্বিকার ভাবে সঙ্গীতাকে খেতে দিতে বলে। অবাক হয়ে সঙ্গীতা তাকাতেই থাকে সুতীর্থ বাথরুমের দিক হাঁটা
দিয়েছে।
রাত এখন কত সুতীর্থ জানেনা। জানার জন্য সে পাশ ফিরে দেয়াল ঘড়িটার দিক তাকায়। দুটো পনেরো বাজে। ঘুমই আসছেনা। এপাশ - ওপাশ করেই এতটা সময় কেটে গেল। নাইটল্যাম্পের নীল আলোয় সুতীর্থ আবার পাশ ফেরে। সঙ্গীতা চিৎ হয়ে ঘুমোচ্ছে। বড়ো শান্তির ঘুম। ঠেলা মেরে জাগিয়ে দিলে কেমন হয়? ওর না আজ মামা মারা গেছে? মুখ সারাক্ষণ থমথমে ছিল? সুতীর্থ হাত দিয়ে ঠেলা
মারতে গিয়েও থমকে যায়। দেখে সঙ্গীতার নাইটির প্রথম হুকটা খোলা। কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর সঙ্গীতাকে দুহাত দিয়ে নিজের দিকে টেনে নেয়। ভিতরে ব্রা পড়েনি বোঝা
যায়। আস্তে হুক তিনটে খুলতেই বেরিয়ে
আসে ফর্সা বুকদুটোর অনেকাংশ। সুতীর্থ একবার তাকায় সঙ্গীতার মুখের দিকে। এখনো ঘুম ভাঙেনি। চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপছে। কোনো স্বপ্ন দেখছে বোধহয়। চোখ সরিয়ে সুতীর্থ হাত রাখে
সঙ্গীতার বাম দিকের নিটোল স্তনে। সাঁপের মতো ঘষটে ঘষটে উঠে আসে সঙ্গীতার বুকের উপর। মাথাটায় ঝিমঝিম ভাব নিয়ে সুতীর্থ ঠোঁট ফাঁক করে দাঁত ছোঁয়ায়
স্তনের উপর। আর তাতেই সঙ্গীতার ঘুম ভেঙে যায়। ভীত গলায় কেঁপে উঠে বলে, ' কে? '
' আমি আবার কে? ' বলেই সুতীর্থ আরেক হাত দিয়ে সঙ্গীতার শরীর ঘাটতে থাকে।
ঘুম ভাঙা চোখে সঙ্গীতা তাকায়। তারপর ধাতস্থ হতেই সুতীর্থকে সরিয়ে দিতে যায়। কিছুটা কাঁটা - কাঁটা স্বরে বলে, ' লজ্জা করেনা? আজকেও? সরো। ' সুতীর্থকে একঝটকায় নামিয়ে দেয়। নাইটির বোতাম আটকাতে আটকাতে হঠাৎ সুতীর্থর মুখের দিক চাইতেই ও চমকে উঠলো। সুতীর্থর চোখদুটো যেন জ্বলছে। সে শীতল দৃষ্টি কি ভয়ানক! সঙ্গীতা অজান্তেই কেঁপে উঠলো। কিছু বলার আগেই সুতীর্থ ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। দুহাতে খামচে ধরলো ওর দুই
বাহু। অস্থিরভাবে খুলতে লাগলো
নাইটির বোতাম। ঘটনার আকস্মিকতায় সঙ্গীতা পুরো হকচকিয়ে গেল। দুহাতে সুতীর্থর মুখটা সরিয়ে দিতে গিয়েও পারলোনা। সুতীর্থ ওকে বিছানায় চেপে
ধরলো সজোরে । সঙ্গীতার এবার কান্না পেল।
' আজ ছেড়ে দাও। আজ হবেনা। প্লিজ সুতীর্থ। '
' চুপ। ভয় করছে তোমার? আমি আছি তো। চুপ। ' ঘড়ঘড়ে স্বরে বললো সুতীর্থ। নীল আলোয় ওকে দেখাচ্ছে একটা জন্তুর মতো। সঙ্গীতা আর তাকাতে পারছেনা। চোখ বন্ধ করে প্রতিরোধহীন প্রতিরোধে অবশ হতে থাকে। চূড়ান্ত মুহূর্তটার সময় সুতীর্থ
ফিসফিস করে যেন কি বলতে থাকে। সঙ্গীতা তা শুনতে পায়না। দাঁত আর নখের আদর শেষ হয়। পাশে পড়ে থাকা সুতীর্থকে দেখে সঙ্গীতার মনে হলো কোনো সরীসৃপ, বিষ ঢালার পর যে নিস্তেজ
হয়ে পড়েছে।
৩
ধুর! আবার ভুল হয়ে গেল। এই নিয়ে দুবার। একরাশ বিরক্তি নিয়ে সুতীর্থ সামনের কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সব কেমন এলোমেলো লাগছে। রঙ, অক্ষর সবকিছু যেন একটা অদৃশ্য
ধাক্কায় গুলিয়ে গেছে। গরমও লাগছে খুব। মাথার উপর হাইস্পিডে ফ্যান চলা সত্ত্বেও সারা শরীর বেয়ে ঘাম নামছে। লোহার পিন্ডের মতো ভারী মাথা
নিয়ে সুতীর্থ চারপাশে তাকায়। সবাই স্বাভাবিক, সুস্থ এবং নিশ্চিন্ত।
' কি ভায়া! এত ঘামছো কেন? শরীর খারাপ নাকি? ' সমরেশ কখন যে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তা সুতীর্থ টেরই পায়নি। জবাব দেওয়ার কথাও সে ভুলে
যায়। সমরেশ ফের ঠেলা মারে ওকে, ' কি হলো? কিছু নিয়ে চিন্তিত নাকি?
' কিছুনা। ঠিকই আছি দাদা। ' সুতীর্থ হেসে উত্তর দেয়। সমরেশদা কি কিছু টের পেয়েছে? সে চোখ সরিয়ে নেয়। কম্পিউটারের দিক তাকিয়ে থাকে। মাউসের উপর উদ্দেশ্যহীন হাত ঘোরাফেরা করতে থাকে।
' ঠিক আছো? আমি ভাবলাম,,,, ' কথা শেষ না করে সমরেশ বলে ওঠে, ' তোমাকে আজ কেমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। অনেকটা টিকটিকির মতো। ' বলেই হাহা করে হেসে ওঠে।
মাউসের উপরে রাখা সুতীর্থর হাত থেমে যায়। সমরেশের দিক চেয়ে থাকে ফ্যালফ্যাল করে। সে দৃষ্টি দেখে সমরেশ থমকে যায়। সুতীর্থর পিঠে চাপড় মেরে বলে, ' চলো খেয়ে আসা যাক। কাজ পরে করো। '
ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে-মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে সুতীর্থ আয়নার সামনে দাঁড়ায়। মুখটিকে একটু ঝুঁকিয়ে দেয়। তাকে কি এখনো সরীসৃপের মতো
দেখতে লাগছে? টিকটিকির মতো ভঙ্গুর, ফ্যাকাশে? আক্রমনের ক্ষমতাও যার শেষ হয়ে গেছে।
ক্যান্টিনের কোনার দিকের টেবিলটায় আজ সমরেশরা বসেছে। গোল টেবিলের চারদিকে চারটে
চেয়ার। সুতীর্থর জন্য একটা খালি
জায়গা রেখে সমরেশরা বসেছে। সুতীর্থ এগিয়ে যায়। চেয়ারটার পিছনেই খোলা জানালা। হাল আমলের নয়, পুরোনো কালের গরাদ দেওয়া জানালা। মোটা-মোটা শিক। তার ওপাশেই বুনো ঝোঁপ, ঝোঁপ পেরিয়ে জলা ডোবা। সুতীর্থ দেখে একটা কাক ঝোপের মধ্যে খাবার খুঁজছে। ক্যান্টিনের বাসি খাবার অনেকসময়ই ওখানে ফেলা হয়। কাকটাকে দেখে ওর ভয় লাগছে। কি কুৎসিত কালো চেহারা। সুতীর্থর সঙ্গে কাকটার
একবার চোখাচোখি হলো। সুতীর্থ তখন কাকটাকে তাড়ানোর জন্য জানালা দিয়ে হাত বের করে শূণ্যে ভাসাতে
লাগে। কিন্তু কাকটা উদাসীন। সে আবার খাবার খোঁজায় মন দেয়। কাকটা কি তাকে উপেক্ষা করছে? মানুষ বলে আর গন্যই করছেনা? না না তা কেন হবে। একটু চেঁচালেই হয়তো কাকটা ভয় পেয়ে উড়ে যাবে। সুতীর্থ বেশী জোরে নয়
আস্তে করে কাকটাকে ধমক দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু গলা দিয়ে কোনো
আওয়াজ বের হচ্ছেনা। আশ্চর্য! এরকম হচ্ছে কেন? আরো দুএকবার সে চেষ্টা
করে কিন্তু কোনো চিৎকার সে করতে পারেনা বরং কাকটা তার খাবার নিয়ে উড়ে যায়। সুতীর্থর দিক পিছন ফিরে
উড়ে যায়। উড়ে যেতেই সুতীর্থর নাকে
প্রস্রাবের ঝাঁঝালো গন্ধ এসে ঝাঁপটা মারে। এদিকে কেউ না আসলেও মাঝেমধ্যে দারোয়ান গিরিশ এসে পেচ্ছাপ
করে যায়। সেই গন্ধই ওর নাকে আসছে। পেচ্ছাপটা গিরিশের। ওর চেহারাটা ভেসে উঠতেই সুতীর্থর
ঘেন্না আরো তীব্র হয়। সে উঠে গিয়ে থুতু ফেলে। বেশ কয়েকবার। একটু জল খাওয়া দরকার। গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে খালি। পুনরায় সে টেবিলে এসে বসে। কৃষ্ণেন্দু, সমরেশ জোর আড্ডা জমিয়েছে। পাশে বসে মহিমদা একমনে খবরের
কাগজ পড়ছে। সুতীর্থ এসে বসতেই সমরেশদের আলোচনা থামে। মহিমের দিকে তাকিয়ে বলে, ' এবার কাগজটা রাখ মহিম। খবর বাড়ি গিয়েও পড়তে পারবি। '
মহিম কাগজটা সরিয়ে রেখে রোজকার মতো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর প্রশ্ন করে, ' রোজ রোজ দুনিয়াটা কেমন বদলে যাচ্ছে রে। মাঝেমাঝে মনেহয় কেন বড়ো
হলাম। সেই ছোটোবেলাতেই কেন জীবনটা
থমকে গেলনা? '
' তোর এই রোজকার প্রশ্নের কি জবাব দেবো বলতো? ' সমরেশ হাসে।
মহিম থেমে যায়। বিরক্ত মুখে বলে, ' আরে ধুর। ইয়ার্কি ছাড়। গত পরশুর কেসটা পড়েছিস? এত খারাপও মানুষ হতে পারে! '
সমরেশ থতমত খেয়ে যায়। সেই অবস্থাতেই বলে, ' কেন কি হয়েছে? একটু খুলে বলতো আমায়। '
' কী আর হবে? সেই রেপ। একটা ক্লাস টেনের মেয়েকে চারজনে মিলে রেপ করেছে। একবার নয় বেশ কয়েকবার। আর যাহ পুলিশ আমাদের! অভিযোগই নাকি নিচ্ছিলনা প্রথমটায়। শেষমেশ চাপে পড়ে নিয়েছে। ' মহিম থামে। কথাগুলো বলার সময় ওর রগ ফুলে
ফুলে উঠছিল। নিজের মেয়ের মুখটা মনে পড়ে যাচ্ছিল হয়তো। সমরেশও ভাবতে থাকে। তার মেয়েটাও ক্লাশ টেন। রোজ টিউশনি থেকে ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বেজে যায়। আসার পথে একটা ক্লাব পড়ে। সমরেশ আর ভাবতে পারেনা। চোখ বন্ধ করে ফেলে।
' রেপটা ঠিক কখন হয়েছে মহিমদা? মানে এক্সাক্ট টাইমটা? ' সুতীর্থর প্রশ্নে সকলে
অবাক হয়ে যায়। অবাক ভাব মুখে নিয়েই মহিম বলে, ' সেটা তো লেখা নেই, তাও আন্দাজ আটটা সাড়ে আটটা। '
' কেউ ধরা পড়েছে মহিম? ' সমরেশ প্রশ্ন করে।
' হ্যাঁ। তবে সবাই নয়। একজন এখনো ফেরার। সেই শুয়োরের বাচ্চাটা কোথায় গেছে তার হদিশ নেই। '
সুতীর্থ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। হাতের সিগারেটটা পুড়তে পুড়তে নিঃশেষ হয়ে আসে। চারজনের একজন এখনো ফেরার। তার মতোই। সুতীর্থর মাথার ভিতর
যন্ত্রনা করছে। প্রায় নিভে যাওয়া সিগারেটটা পরপর বেশ কয়েকবার টান দিল সে। ধোঁয়া হচ্ছেনা। বরং ফাঁপা একটা আওয়াজ বেরোচ্ছে
দুই ঠোঁট চিরে। আরেকটা সিগারেট ধরালো ও।
' যাক পুলিশ তো ধরেছে। দেখা যাক কি হয়! '
কৃষ্ণেন্দু এতক্ষণ চুপ করে ছিল। সমরেশের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো, ' কি আর হবে দাদা! বড়জোর চার-পাঁচ বছরের জেল! তারপর আবার তো এরা ফিরে আসবে এই সমাজেই। এদের নিয়েই চলবে সমাজ। পোকায় কাঁটা সমাজ। '
মহিম মাথা নেড়ে সমর্থন জানায়। তারপরই বলে, ' সরাসরি যাবজ্জীবন হওয়া উচিত। নাহলে এরা শোধরাবে না। পচে মরুক জেলের অন্ধকারে। '
' না মহিমদা। ধর্ষণের একমাত্র শাস্তি হওয়া উচিত মৃত্যু। এদের অন্ধকারে বাঁচারও অধিকার নেই। অবশ্য আমাদের দেশে ধর্ষকের
ফাঁসি হয় ধর্ষিতা কতটা মরা মরেছে তা দেখে। ' কৃষ্ণেন্দুর চোখমুখ শক্ত হয়ে ওঠে। সুতীর্থর দিক ফিরে বলে, ' কিরে? ঠিক বলিনি? '
সুতীর্থ চমকে ওঠে। তারপরই সজোরে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। ' অবশ্যই। ঠিকই বলেছিস। '
সুতীর্থর অস্থিরতা কৃষ্ণেন্দুর নজর এড়ায়না। বলে, '
তোকে কেমন অসুস্থ
লাগছে। শরীর ঠিক আছে তো তোর? '
' হ্যাঁ! হ্যাঁ! ঠিকই আছি। ' সুতীর্থ হেসে উত্তর দেয়। কৃষ্ণেন্দুর বড়ো বড়ো দুটো চোখ ওকে বারবার অস্বস্তিতে ফেলছে। সুতীর্থ তাকাতে পারছেনা। মাথা নীচু করে সে মনে মনে
আওড়াতে থাকে, ' ধর্ষণের একমাত্র শাস্তি মৃত্যু! ' একমাত্র! যাবজ্জীবনও নয়। আচ্ছা কৃষ্ণেন্দু যদি জানতে পারে সে অর্থাৎ সুতীর্থ গতরাতে তার স্ত্রীকে ধর্ষণ
করেছে তবেও কি ওর রায় একই থাকবে? সুতীর্থর ভাবনা আর এগোতে পারেনা। সিগারেটটাও শেষ হয়ে আসছে। একটু জোরেই পরপর কয়েকটা টান দিল সে। গাঢ় ধোঁয়ায় সে মুছে দিতে চাইছে তার পাশের তিনজনকে। কুয়াশার মতো ধোঁয়া বের হলে
ভালো হয়। সুতীর্থ খুশী হতে গিয়েও দেখলো
ধোঁয়া কেটে গিয়ে ফের স্পষ্ট হয়ে উঠছে তিনটি মুখ। দুই আঙুলের ফাঁকে পুড়ে শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটটার দিক
তাকায় সুতীর্থ। হাসি ফুটে ওঠে ওর মুখে, নিজেকে আড়াল করার কি হাস্যকর চেষ্টা।
তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে উঠে সুতীর্থ দেখলো আজ স্টেশনে ভিড় একটু কম। সচরাচর এমনটা দেখা যায়না। আশপাশের লোকজনের চিৎকার, পানের দোকান থেকে ভেসে
আসা হিন্দি গান এসব ছাপিয়ে যান্ত্রিক মহিলা কন্ঠ জানান দিচ্ছে সুতীর্থর ঘরে ফেরার
ট্রেন দুনম্বর প্ল্যাটফর্মে আসবে। সুতীর্থ ঘড়ির দিক তাকালো। এখনো মিনিট পনেরো মতো বাকি আছে। দু নম্বরে এখনই যেতে ইচ্ছা করছে না। বলতে গেলে আর কোথাওই যেতে ইচ্ছে করছেনা। ওর সারা শরীরটা কেমন জমাট বাধা বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে সারা শরীরের কোশে
কোশের মধ্যে বড়সড় ফাঁক তৈরি হয়েছে। আর সেই ফাঁক দিয়ে সূচঁ বেঁধার মতো হাওয়া ঢুকছে। সুতীর্থর এখন শীত করছে কেমন। মাথাটা অসম্ভব ভারী। ভেতরে কেমন দপদপ করছে। সুতীর্থর মনে হচ্ছে এই মাথাটা ও আর বেশীক্ষণ বয়ে নিয়ে
যেতে পারবেনা। পিছনের একটা ফাঁকা বেঞ্চিতে ও বসে পড়লো। বিয়ের পর সঙ্গীতাকে নিয়ে একবার এখানে বসেছিল। এই বেঞ্চিটাতেই কি? কে জানে। সুতীর্থর জানার আর ইচ্ছাও
নেই। সে পকেট হাতড়ায়। সিগারেটের খাপটা নেই। কোথাও ফেলে এসেছে হয়তো। পাশেই দোকান। ইচ্ছে করলেই কিনে আনা যায়। কিন্তু সুতীর্থ নিশ্চিত ও
সিগারেট ধরাতে পারবেনা। শেষ অবলম্বনহীন সুতীর্থ এবার উঠে দাঁড়ায়। ট্রেন আসার সময় হয়ে গেছে। প্রচণ্ড ভারী ভাবটা মাথা থেকে
সারা শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। ওকে দুনম্বরে যেতে হবে। সুতীর্থ হাটতে থাকে। মাথার উপরের ওভারব্রিজটা যেন মাথার ওপর চেপে বসেছে। ব্রিজে একএকজন উঠলেই সেই ভার আরো বেড়ে যাচ্ছে। সুতীর্থ একটু দ্রুতই হাঁটতে হাঁটতে নেমে আসে রেললাইনে। সুতীর্থর মনে হচ্ছে কারা
যেন চিৎকার করছে। কাউকে সাবধান করছে যেন। সুতীর্থ মাথা ঘামায়না।ঘামানোর মতো অবসরও তার নেই। সে হাঁটতে থাকে। মাথাটা এবার ছিঁড়েই যাবে
মনেহয়। সুতীর্থ আর চলতে পারেনা। দুহাতে মাথা চেপে ধরে দাঁড়িয়ে
পড়ে। চারপাশ ক্রমশ বোবা হয়ে আসছে। শব্দহীন, দৃশ্যহীন। সুতীর্থ সব ভুলে যাচ্ছে। ভুলে যেতে যেতে সুতীর্থ হঠাৎ
একটা প্রচণ্ড ধাক্কা খেলো। সুতীর্থ কিছুটা সময় শূণ্যে ভাসলো। ভাসতে ভাসতে সুতীর্থ দেখলো তার ঘরে ফেরার ট্রেনটা তাকে উড়িয়ে নিয়ে চলেছে। এক্ষুনি হয়তো কোনো পোস্টে
ও ধাক্কা খাবে। অথবা লাইনেই মুখ থুবড়ে পড়বে। শরীরটা থেঁতলে যাবে। ঘাড় মাথার অস্তিত্ব আর থাকবেনা। তারপর অনেকে তার থ্যাতলানো শরীরটা দেখে
শিউরে উঠবে। এখানে অথবা বাড়ি ফিরে
কারো কারো বমিও পাবে। পাক। মুক্তির আগে অনেক যন্ত্রণা থাকে।