ঘাতক
কারোর মুখে কোন কথা নেই । বসে বসে একমনে শুধু নিজেদের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনে
চলেছেন জনা কয়েক মানুষ । চোখের দৃষ্টি স্থির
। ঘোলাটে মণিকোঠার ভিতরে নিরন্তর বিষণ্ণতা ।
মনিময় ঘোষাল ছায়ার
মতো নিঃশব্দে সেই মানুষগুলোর পাশে এসে দাঁড়ালেন । সেভাবে কেউ ওনাকে লক্ষ্যই করল না,
করলেও সম্ভাষণ করে নীরবতার শব্দভঙ্গে সচেষ্ট হল না । মনিময় বাবুও ওদের মতোই উদাসীন
ভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন । তার চোখেমুখেও নিদারুণ বিষণ্ণতার ধূসর ছায়া । এটা একটা ছোটোখাটো
পার্কের মতো জায়গা । রোজই বিকালে একটু হাঁটাহাঁটি করতে এখানে আসেন তিনি । সমবয়েসি আরও
জনাকয়েক এসে জোটে । শরীরচর্চার সাথে সাথে একটা বৈকালিক আড্ডা জমে ওঠে বেশ । সদ্য রিটায়ার
করা মানুষজন সব, বয়েস মোটামুটি ষাট থেকে পঁয়ষট্টির মধ্যে । এদিক-সেদিকের নানা কথা নিয়ে
চলে গল্পগুজব । কিন্তু আজকের পরিস্থিতিটা একেবারে অন্যরকম । সবাই চুপচাপ । শ্যামা মুখুজ্জে,
কাজল মিত্তির সহ আড্ডার নিয়মিত সদস্যরা উপস্থিত থাকলেও কেউ কোন কথা বলছে না । এসে পৌঁছানো
মাত্রই মনিময় বাবু এই থমথমে ব্যাপারটা আঁচ করলেন । আড্ডাবন্ধুদের এই অস্বাভাবিক নীরবতার
কারণ অবশ্য তিনি জানেন । আজ সকালেই তুষার দত্ত মারা গেছে । একদম
আচমকাই । সকালে দোকানে গিয়েছিল, রোজকার মতো কাজ করছিল হঠাতই বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ
বুকে যন্ত্রণা, স্ট্রোক এবং ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই জলজ্যান্ত মানুষটা শেষ । তুষার দত্ত এ আড্ডার অন্যতম সদস্য । তারই
আচমকা মৃত্যুসংবাদের ভার সকল আড্ডাবন্ধুদের এরকম ভাষাহীন করে দিয়েছে ।
তুষার দত্ত বেশ পয়সাওলা
লোক । কোলকাতার যে কোন বড় নার্সিংহোমে লাখ লাখ টাকা ঢেলেও চিকিৎসা করানোর ক্ষমতা ছিল । কিন্তু এই আচমকা স্ট্রোক এমনই যে ডাক্তারের কাছে
নিয়ে যাওয়ার সুযোগটুকুও দিল না । আচমকা সেই যে বুক চেপে ধরে পরে গেল আর উঠতেই পারলো
না । স্ট্রোক জিনিসটা এমনই মারাত্মক ।
মনিময় বাবু বেশ কিছুক্ষণ সময় নিলেন । নিজের বিষণ্ণতাটাকে
সেই গুমোট দমবন্ধ হাওয়ায় মিশিয়ে দিয়ে উদাসীন চোখে বসে রইলেন আর সকলের মতো । আড্ডার
মেজাজও থমথমে । মাঝে মধ্যেই বুকচাপা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে শুধু । সকলেই নিজের
ভেতরের কষ্টটা নীরবতার আড়াল দিয়ে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে । নিশ্চল কিছু সময় কাটে
। তারপর মৌনতা ভঙ্গ করে শ্যামা মুখুজ্জেই প্রথম কথা বলে ওঠলেন ‘কি যে মানুষের জীবন
! কার কখন কি হয়ে যায়, কে জানে !’
‘স্ট্রোক এমনই জিনিষ
গো দাদা । শক্ত সামর্থ্য মানুষকে দু’মিনিটে শুইয়ে দিচ্ছে’ পাশে বসা সহদেব রায় শ্যামা
মুখুজ্জের আক্ষেপটাকেই আরও একটু প্রসারিত করল ।
‘হম, তুষারের নাহলে কিবা এমন বয়েস ।
তবুও দ্যাখো…’ প্রত্যুত্তরটা আর শেষ করতে পারলেন
না মুখুজ্জেদা তার আগেই গলা বুজে এলো ।
‘তুষারের তো একবার বাইপাস সার্জারি হয়েছিল
না? বাইপাস হলে স্ট্রোক অবধারিত’ কাজল মিত্তির তথ্য সংযোজন
করে বলে উঠলো । ‘আরে বাইপাস কি বলছ । আমার
এক অফিসের কলিগ । আমার চেয়েও ছোট । শরীরে কোন রোগ নেই । দুম করে সেদিন অফিসে আসতে
গিয়ে স্ট্রোক । একদম হাট্টাকোট্টা মানুষ’ –এবারে বিকাশ
ঘোষ উদাহরণ দেন । মনিময় বাবু সংলাপে অংশ নেন না বটে কিন্তু মন দিয়ে সকলের কথাই শোনেন
। সত্যিই স্ট্রোক নামক এই মারনরোগটা ইদানীং খুব মারাত্মক হয়ে উঠেছে । নাহলে তুষারের
মতো দিব্যি সুস্থ সবল মানুষটা এমন দুম করে শেষ হয়ে যেতে পারলো ! শুধু তুষার কেন গত
কয়েকমাসে এই এলাকার অশোক পাল, পরিমল কুণ্ডু সহ প্রায় জনা চারেক মারা গেছে এই স্ট্রোকেই
। সবারই বয়েস পঁয়ষট্টির মধ্যে । শোকের সাথে সাথে একটা ভয়ও পাকিয়ে ওঠে মনে । বয়সটা ওনার
নিজেরও পঁয়ষট্টি হয়েছে , দুম করে কিছু একটা হয়ে যেতে কতক্ষন । আশঙ্কা একা মনিময় ঘোষালের
না, আশঙ্কা সবার মনেই । তাই সহজেই তুষারের মৃত্যুর শোক অতিক্রম করে নিজেদের বেঁচে থাকা
নিয়ে একটা নিদারুণ আশঙ্কার আলোচনায় গোটা আড্ডাটা মোড় নিতে থাকে ।
‘আসলে
সময়টাই খারাপ । মানুষের জীবনের আজকাল আর কোন গ্যরেন্টি নেই’ শ্যামা মুখুজ্জে
কিছুক্ষণ নীরবতার পর আবার বলে ওঠে । ‘আগেকার দিনে লোকে আশি পঁচাশি
অব্দি বেঁচে থাকতো । এখন ষাট পেরলেই...’
‘আজকাল সবে ভেজাল । চারিদিকে দূষণ ! খাবারে বিষ, জলে বিষ, বাতাসে বিষ। কি করে মানুষ
ভালো থাকবে।’
‘তাই তো, বিষ খাচ্ছি, বিষ টানছি । সারা
দেশ ধোঁয়ায় ধুলোয় আর প্লাস্টিক আবর্জনায় ভরে উঠেছে । এই অবস্থায় বেঁচে থাকাই
দুর্দায়’ এবার মনিময় ঘোষাল উত্তর দেয় ।
মানুষের এই অকালে অযাচিত মৃত্যুর কারণ হিসাবে যুগের হাওয়াকে দাঁড় করাতে পেরে
একটু যেন ভারমুক্তই হন । আসলে বুকের ভারটা কোনোভাবে একটু কমানোর জন্য ভেতরটা আঁকুপাঁকু
করছে অনেকক্ষণ ধরেই । একটা অদ্ভুদরকমের অস্বস্তি সজোরে চেপে ধরছে । এই তো কালকেও তুষার পাশে বসেছিল, এই আড্ডাতেই, এই
বেঞ্চেই । রাজনীতি নিয়ে জোর তর্ক করছিলো । বর্তমান শাসক দলের মুণ্ডপাত করছিল হাত-পা
নেড়ে । আর আজ সেই লোকটাই নেই । মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা । সকালে তুষারের দুঃসংবাদটা পাওয়ার
পর থেকেই ভেতরটা মুচড়ে মুচড়ে উঠছিল । সারাদিন বাড়ির মধ্যেই ছিলেন । মনটা বিষণ্ণ । বিকাল নামতে বিষণ্ণতাটা আরও
বেশি করে জাপটে ধরছিল । ঘরের বাতাসটাও যেন গুমোট হয়ে বুকে লাগছিল, তাই এই আড্ডায় আসা
নাহলে আজকে বেরোনার তেমন ইচ্ছে ছিল না । বন্ধুদের মাঝে এসে একটু যদি মনটা হালাকা হয়
। কিন্তু হালকা হচ্ছে না বরঞ্চ আরও ভারী হয়ে উঠছে । শোককে ছাপিয়ে উঠেও একটা অজানা আশঙ্কা
বড় বেশি করে প্রকট হয়ে উঠছে ।
বন্ধুদের দুশ্চিন্তার কথা শুনতে শুনতে নিজের মনেও জমছে অনিবার্য ভয় ।
মৃত্যুভয় !
একসময় বয়েস ছিল,
রক্তের জোর ছিল । এখন বয়স হয়েছে, রক্তের জোর কমেছে । শরীরের কল-কব্জায়
এসেছে শিথিলতা, মনের জোর কমেছে অনেকটা । আর পাল্লা দিয়ে বেড়েছে শরীর
নিয়ে দুশ্চিন্তা করার ক্ষমতা । জীবন শেষ হয়ে আসছে বলেই কি মৃত্যুকে এতো ভয় ! ষাট-বাষট্টি
বছর বয়েসটা মরে যাওয়ার বয়েস নয় । জীবনের অনেক দায়িত্ব কর্তব্য তখনও অসম্পূর্ণ । সে
অবস্থায় চলে যেতে কেই বা চায়। তবু প্রতিনিয়তই চারিদিকে এই
অযাচিত মৃত্যুমিছিল ।
মানুষের
সাথে দেখা হলেই আগে শরীরের খবর । সবাই আশঙ্কিত, কারোরই যেন শরীর ভালো নেই ।
চারিদিকে বড় বড় বিজ্ঞাপনেও শুধু আসুস্থতার কথা । ঝাঁ-চকচকে
নার্সিংহোমের বিজ্ঞাপন । কোথাও ‘চার ইঞ্চি কেটে বাইপাস’ করার দুর্নিবার হাতছানি কোথাও বা দগদগে লাল হৃদযন্ত্রকে টাটকা গোলাপের
মতো ধরে রেখে ডাক্তারবাবুর বিশ্বস্ত হাতের ঝলকানি । রাস্তাঘাটে চোখে পরে সবারই । দেখে
দেখে ভয় হয় । আশ্বাসের আড়ালে আশঙ্কাটাই বড় হয়ে ওঠে । কতশত নার্সিংহোম গজিয়ে উঠছে
দিকে দিকে । কত তাদের রমরমা । কাগজে- টিভিতে বিজ্ঞাপনে বিজ্ঞাপনে ছয়লাপ । আসলে
মানুষের শরীর যে সত্যিই বিপন্ন এবং যেকোনো মুহূর্তেই যে কারোর কিছু একটা হয়ে যেতে
পারে সেই অশনি সঙ্কেতই বারবার জানান দিয়ে যায় । এই আড্ডাতেই কতবার কত আলোচনা হয়েছে । কোন নার্সিংহোমের
পরিষেবা ভালো, কারা চার্জ বেশি নেয়, কোথায় জীবনের গ্যারেন্টি, কার কোন আত্মীয়
কতদিন কোথায় ভর্তি ছিল – হাজারো কচকচানি ।
এসব আলোচনার অগোচরে আসলে জীবনের বিপন্নতার কথাটাই বেশি ফুটে ওঠে । এমনই এক বিপন্নতা
যাকে কোনভাবেই অতিক্রম করা যায় না । প্রতি মুহূর্তে মনে হয়
এই বুঝি তার নিজেরই কিছু হয়ে গেল । তুষারের মতই আচমকা বুঝি তার নিজের হৃদযন্ত্রটাও
থেমে গেল ।
আড্ডাটা
আজ আর বেশিক্ষণ চলল না । সন্ধ্যা ঘনানোর মুখেই ভেঙে গেল । বুকের প্রছন্ন তোলপাড়
নিয়েই সকলে প্রায় নিঃশব্দে বিদায় নিল । বাড়ি ফেরার পথে মনিময় বাবু মুহূর্তের জন্যও
স্থির হতে পারলেন না । বারবার মনের ভেতর কি যেন একটা আতঙ্ক চমকে চমকে গায়ে কাঁটা
দিয়ে উঠছে ।
আজকের ওয়েদারটাও
খুব গুমোট । চাপা থমথমে । হাওয়া বইছে না একদম । ঘরে ঘরে অদ্ভুত রকমের স্তব্ধতা ।
শুধু তুষারের বাড়ির ওদিক থেকে মাঝে মধ্যে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে । আর বুকের
শূন্য নালিপথের অলিগিলিতে সেই আওয়াজ পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠছে । শ্মশানযাত্রীরা বডি
নিয়ে চলে গেছে একটু আগেই । মনিময় বাবু দুপুরের দিকে একবার গিয়েছিলেন বন্ধুকে
শেষবারের মতো দেখতে । বেশিক্ষন থাকতে পারেননি । তুলসি পাতায় ঢেকে দেওয়া তুষারের
চোখদুটোর দিকে তাকাতে গিয়ে বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠেছিল । মাথার পাশে জ্বালানো একগুচ্ছ ধূপের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে শ্বাসরোধ করে
দিচ্ছিল । সারাদিনের এই দমবন্ধ পরিবেশটা সন্ধে হতেও কাটল না । অন্ধকার নামার সাথে সাথে যেন অস্বস্তিটা আরও বেশি করে
চেপে ধরছে ।
বাড়ি
ফিরেও অস্থির মনটাকে শান্ত করতে পারলেন না তিনি । অভ্যাসমত হাত-পা ধুয়ে
পোশাক বদলে যখন নিজের ঘরে ঢুকলেন তখন পাশের ঘর থেকে স্ত্রীর গলা শুনতে পেলেন ।
ফোনে মেয়ের সাথে কথা হচ্ছে । মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে । এলাকায় তুষার কাকু মারা গেছে এ দুসংবাদটা
দেওয়ার মধ্য দিয়ে মনের ভার লাঘবের চেষ্টা করছে গিন্নী । রোজই মেয়েকে ফোন করা অভ্যাস
। একটা মেয়ে, দূরে শ্বশুরবাড়ি বলে ব্যগ্রতা আরও বেশি । বাক্যালাপের শেষের কয়েকটা
কথা কানে এলো মনিময় বাবুর । ‘তোর বাবারও তো বয়স হচ্ছে । আমার
কি চিন্তা হয় । চারিদিকে যা সব হচ্ছে।’ নিজের ঘরে বসে কথাগুলো
শুনতে পেলেন তিনি । দুম করে কেউ যেন হাতুড়ি পিটে দিল বুকে ।
অনেক
রাত অব্দি ঘুমানোর চেষ্টা করলেন মনিময় বাবু কিন্তু পারলেন না । নিরন্তর দুশ্চিন্তা মনকে বারবার বিক্ষিপ্ত
করে দিচ্ছে । যতই টেনশান ফ্রি থাকার চেষ্টা করুন না কেন, উদ্বেগ জিনিশটা আপনা আপনিই
চলে আসছে । তুষারের মতো আচমকাই তার জীবনেও ঘনিয়ে আসবে নাতো চরম মুহূর্ত । ইদানীং মাঝে
মাঝে নিজের শরীরটাও দুর্বল লাগে । সকালে মর্নিংওয়াক করতে বেরুলে মাথা ঘুরে যায় । প্রেসারটা
কদিন আগেই চেক করিয়েছেন তবু ভয় হয় আবার বাড়ল নাকি । কাজল মিত্তির প্রায়ই বলে একবার
ইসিজি করিয়ে রাখতে । দিন কয়েকের মধ্যেই করিয়ে নিতে হবে । গোটা শরীরটা যন্ত্রে ফেলে
দেখে নেওয়া দরকার কোথাও কোন রোগ-ব্যাধি লুকিয়ে বাসা বেঁধে রইল কিনা । রাশি রাশি ভাবনারা
মাথায় ঝেঁকে ধরে মনিময়বাবুর । ডাক্তারবাবু পই পই করে বলেন একদম দুশ্চিন্তা না করতে,
তবু চিন্তার জাল বাধা মানে না । বিছানায় শুয়ে ছটফট করেন তিনি । চোখ বুজতে পারছেন না
। সদ্য মারা গেছে কাছের বন্ধু । কি করে আজ রাতে চোখে ঘুম
আসবে মনিময় ঘোষালদের । শুধু আকাশ পাতাল
দুশ্চিন্তার ঝড় বইছে মাথায় । আর দুশ্চিন্তার
কালো হাত ধরেই একটা আচমকা অ্যাটাক কখন যে ঘাতক
হয়ে উঠছে খেয়াল করছে না কেউই । খুব তাড়াতাড়িই এলাকায় আবার হয়তো তুষার দত্তের মতো কারো
একজনের স্ট্রোক হবে ।
ধন্যবাদ !
ReplyDelete